অর্থনৈতিক নৃবিজ্ঞান নৃবিজ্ঞান জ্ঞানকাণ্ডের গুরুত্বপূর্ণ উপশাখাগুলোর একটি। এ শাখাটি মানুষের অর্থনৈতিক জীবনকে তাদের নির্দিষ্ট সামাজিক-সাংস্কৃতিক প্রেক্ষিতে বিশ্লেষণ এবং ব্যাখ্যা করে। এটি মানুষের অর্থনৈতিক জীবনধারাকে সমাজ- সংস্কৃতির অংশ হিসেবে দেখে থাকে।
সংজ্ঞায়নঃ
অর্থনৈতিক নৃবিজ্ঞান এমন একটি ক্ষেত্র যা তার বিস্তৃত ঐতিহাসিক, ভৌগলিক এবং সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে মানব অর্থনৈতিক আচরণকে ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করে। এটি অর্থনীতি এবং নৃতত্ত্বের সংমিশ্রণ; অর্থনীতির শাখার সাথে একটি জটিল সম্পর্ক রয়েছে। বিভিন্ন নৃবিজ্ঞানী অর্থনৈতিক নৃবিজ্ঞানের সংজ্ঞা দাড় করিয়েছেন। যেমন-
- রেইমন্ড ফার্থ বলেন, মানুষের সামাজিক জ্ঞাতিগোষ্ঠীর অর্থনৈতিক দিকগুলো (“the economic aspects of social relatives”) নিয়ে অর্থনৈতিক নৃবিজ্ঞান প্রাথমিকভাবে আলোচনা করে।
- ম্যানিং ন্যাশের মতে, এটি “সমাজের একটি উপ ব্যবস্থা হিসেবে অর্থনৈতিক জীবনকে” বিশ্লেষণ করে থাকে।
- বিলস ও হোইয়ার (RALPH L. BEALS and HARRY HOIJER) বলেন, অর্থনৈতিক নৃবিজ্ঞান “সামাজিক ও সাংস্কৃতিক উপ-ব্যবস্থায় প্রাতিষ্ঠানিক বা আনুষ্ঠানিকভাবে বিভিন্ন পণ্য ও পরিষেবার উৎপাদন এবং সেগুলোর বিতরণ এবং ভোগ” নিয়ে অধ্যয়ন করে।
- মেলভিল হার্স্কোভিটস (Melville J. Herskovits) তার Economic Anthropology (1960) বলেন, অর্থনৈতিক নৃবিজ্ঞান মূলত আদিম জনগণের অর্থনৈতিক জীবনকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে, যেখানে পাশ্চাত্য অর্থনীতিতে উপস্থিত অনেক উপাদান (যেমন অর্থ, একটি বাজার ব্যবস্থা) অনুপস্থিত ছিল। নৃবৈজ্ঞানিক পর্যবেক্ষণ পদ্ধতি মাধ্যমে অ-পুঁজিবাদী সমাজগুলোয় সরাসরি পর্যবেক্ষণ করে নৃবিজ্ঞানীরা বিশ্বব্যাপী অর্থনৈতিক ক্রিয়াকলাপগুরোর উপর সমৃদ্ধ তথ্য সংগ্রহ করেন।
ইতিহাসঃ
নৃবিজ্ঞানের একটি উপ-ক্ষেত্র হিসাবে এর উৎস প্রচলিত বাজার ব্যবস্থার বিকল্প হিসাবে পারস্পরিক ক্রিয়াকলাপের উপর গুরুত্বারোপ করে পোলিশ প্রতিষ্ঠাতা ব্রনিস্লো মালিনোস্কি এবং ফরাসী মার্সেল মসের কাজ দিয়ে শুরু হয়েছিল। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে বিনিময় ব্যবস্থাকে কেন্দ্র করেই অর্থনৈতিক নৃতত্ত্বের অধ্যয়নগুলোর ভিত গড়ে উঠেছে। এর বিপরীতে, “রাজনৈতিক অর্থনীতি” হিসাবে পরিচিত মার্ক্সবাদী স্কুলটি উৎপাদনকে কেন্দ্র করে এগিয়ে চলেছে।
ব্রোনিস্লো ম্যালিনোস্কির সবচে গুরুত্বপূর্ণ কাজ Argonauts of the Western Pacific (১৯২২)। এই বইতে তিনি এ প্রশ্নটি করেছেন, “পুরুষরা কেন জীবনের ঝুঁকি নিয়ে উত্তাল সমুদ্রের বিশাল প্রান্তে ভ্রমণ করে শামুক কুড়িয়ে আনে? এটা কি শুধুই মূল্যহীন উপহার সামগ্রী বা ট্রিনকেট?” ট্রব্রিয়ান্ড দ্বীপপুঞ্জ জুড়ে ব্রেসলেট এবং নেকলেসের বিনিময়ের নেটওয়ার্কটি যত্ন সহকারে সনাক্ত করেছিলেন তিনি। ম্যালিনোস্কি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন যে, এই ট্রব্রিয়ান্ডবাসীরা কুলা রিংয়ের বিনিময় ব্যবস্থার অংশ ছিল। তিনি বলেছিলেন যে এই বিনিময় ব্যবস্থাটি স্পষ্টভাবে রাজনৈতিক কর্তৃত্বের সাথে যুক্ত ছিল।
1920 এবং তার পরে ম্যালিনোস্কির গবেষণাটি ফরাসী নৃতাত্ত্বিক ও লেখক মার্সেল মউসের সাথে বিতর্কের বিষয় হয়ে উঠে। মার্সেল মস কার বিখ্যাত বই দ্য গিফট (১৯২৫)। ম্যালিনোস্কি ট্রব্রিয়ান্ডবাসীদের মধ্যে পণ্য বিনিময় এবং তাদের প্রদত্ত অ-পরার্থপর উদ্দেশ্য সম্পর্কে জোর দিয়েছিলেন: তারা সমান বা তার চেয়ে বেশি মূল্যের প্রত্যাশার আশা করে। অন্য কথায়, পারস্পরিক আচরণ উপহার দেওয়ার একটি অন্তর্নিহিত অংশ; পারিশ্রমিকের প্রত্যাশা ছাড়াই কোনও “বিনামূল্যে উপহার” দেওয়া হয় না। মস অবশ্য বলেন যে, এই উপহারগুলি কেবল ব্যক্তিদের মধ্যেই নয়, বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর প্রতিনিধিদের মধ্যে ছিল।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরে, অর্থনৈতিক নৃবিজ্ঞানী অর্থনৈতিক ইতিহাসবিদ কার্ল পোলানী-এর কাজ দ্বারা অত্যন্ত প্রভাবিত হয়েছিল। পোলানী নৃবৈজ্ঞানিক গবেষণার প্রতি আকৃষ্ট করেন যে, সত্যিকারের বাজার বিনিময় ব্যবস্থা কেবলমাত্র সীমাবদ্ধ সংখ্যক পশ্চিমা ও শিল্প সমাজের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল। তিনি যুক্তি দিয়েছিলেন যে অ-শিল্প সমাজগুলোতে আনুষ্ঠানিক অর্থনৈতিক তত্ত্ব (ফরমালিজম) প্রয়োগ করা ভুল ছিল। অ-শিল্প সমাজগুলোয় আত্মীয়তা, ধর্ম এবং রাজনীতির মতো অ-বাজার প্রতিষ্ঠানে বিনিময় প্রথা চালু ছিল। তিনি এই পদ্ধতিকে সাবস্টিটিভিজম হিসাবে চিহ্নিত করেছিলেন। সেসময় ফর্মালিস্ট-সাবস্টিটিভিস্ট বিতর্কটি অত্যন্ত প্রভাবশালী ছিল এবং এটি একটি যুগকেও নির্দেশ করে।
এর পরবর্তীতে বিশ্বায়নের যুগে এসে বাজার ও অ-বাজারের অর্থনীতি তথা “পশ্চিম এবং বাকি”- এর মধ্যে বিভেদ অচল হয়ে পড়ে। নৃবিজ্ঞানীরা বাজারের সমাজগুলোর বিভিন্ন ধরণের বিনিময় ব্যবস্থার সম্পর্কের দিকে তাকাতে শুরু করেন। নব্য-সাবস্টিটিভিস্টরা বাজারের সমাজগুলিতে তথাকথিত খাঁটি বাজার বিনিময় যেভাবে বাজারের আদর্শের সাথে মানিয়ে নিতে ব্যর্থ হয়েছে সেগুলি পরীক্ষা করে। এখন একটি নৃবৈজ্ঞানিক দৃষ্টিকোণ থেকে কর্পোরেশন, ব্যাংক এবং বৈশ্বিক আর্থিক ব্যবস্থার কার্যক্রম অধ্যয়ন করে।
অর্থনৈতিক নৃবিজ্ঞানের পরিধি বা ক্ষেত্রঃ
অর্থনৈতিক নৃবিজ্ঞানের যাত্রা শুরুর প্রাক্কালে এটির পরিধি আদিম মানুষের অর্থনৈতিক জীবন যাপন মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল। সময়ের পরিবর্তনে এটির পরিধি আরো ব্যাপক ও বিস্তৃত হয়েছে। তবে নৃবিজ্ঞানের অর্থনৈতিক জ্ঞানকান্ডীয় বিতর্কগুলো নিম্নোক্ত কয়েকটি ক্ষেত্রকে কেন্দ্র করেই হয়েছে। যেমনঃ
(ক) পশ্চিমা নির্মিত অর্থনৈতিক বিশ্লেষণের প্রত্যয়গুলোর সার্বজনীন প্রয়োগযোগ্যতা (The universal applicability of western generated categories of analysis.)।
(খ) মূল্যের প্রশ্ন (Question of Value)
(গ) ইতিহাস ও রাজনীতির সম্পর্ক।
(ঘ) অর্থনৈতিক প্রক্রিয়ায় সমাজ-সংস্কৃতির প্রভাবের মাত্রা।
এর পরিধি আদিম, কৃষক এবং আধুনিক সমাজগুলোর অর্থনৈতিক জীবন অধ্যয়নকে অন্তর্ভুক্ত করে আরো বিস্তৃত হয়েছে। নিম্নে এটির বেশ কয়েকটি ক্ষেত্র তুলে ধরা হলো।
- Anthropology of Subsistence Systems
- Anthropology of Economic History
- Anthropology of Primitive Economy
- Anthropology of Peasant Economics
- Anthropology of Entrepreneurships
- Anthropology of Urban Economics
- Business Anthropology
- Anthropology of Economic Holism
- Anthropology of Economic Development
- Anthropology of Development and Underdevelopment
গুরুত্ব ও প্রাসঙ্গিকতাঃ
প্রথাগত নৃবৈজ্ঞানিক দৃষ্টিকোণ থেকে অপেক্ষাকৃত সরল ধরনের সমাজের প্রেক্ষিতে অর্থনৈতিক বা রাজনৈতিক হিসাবে আলাদা করে শনাক্ত করা যায়, এমন কর্মকাণ্ড বা প্রতিষ্ঠানও বিরল ছিল। এ ধরনের সমাজে ‘বাজার ব্যবস্থা’ বলে কিছু ছিল না বা থাকলেও সেটাই অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের মূল নির্ধারক ছিল না। ফলে যেখানে অর্থনীতিবিদরা ব্যস্ত থেকেছেন বাজার ব্যবস্থার গতিপ্রকৃতি বোঝার কাজে, সেখানে নৃবিজ্ঞানীদের অনেকে দেখতে চেয়েছেন বাজার ব্যবস্থার অনুপস্থিতিতে বা এর বাইরে বিভিন্ন অর্থনৈতিক লেনদেন কিভাবে সম্পন্ন হয়।
- অর্থনৈতিক নৃবিজ্ঞানের পদ্ধতিগুলো সামাজিক সাংস্কৃতিক নৃবিজ্ঞান মৌলিক পদ্ধতিগুলোর মতো একই।
- অর্থনীতির অপ্রাতিষ্ঠানিক ক্ষেত্রগুলোর উপর বিশেষভাবে করে এটি, যা নৃবিজ্ঞানের এই উপশাখাকে অনন্যতা দান করেছে। অর্থাৎ প্রচলিত অর্থনৈতিক ব্যবস্থা যেখানে শুধুমাত্র প্রাতিষ্ঠানিক অর্থব্যবস্থা বা বিনিময় ব্যবস্থাকে গুরুত্ব দেয়, সেখানে অর্থনৈতিক নৃবিজ্ঞান অপ্রাতিষ্ঠানিক ক্ষেত্রগুলোর উপর ফোকাস করে।
- সাংস্কৃতিক নৃবিজ্ঞানীরা শুরুর দিকে সমাজ-সংস্কৃতি ব্যাখ্যায় মানুষের অর্থনৈতিক দিকগুলোকে তুলে ধরেননি। পরবর্তী সময়ে ম্যালিনোস্কির নেতৃত্বে অর্থনৈতিক নৃবিজ্ঞানের যে যাত্রা শুরু হয়, সেখানে অর্থনীতিকে সমাজ-সংস্কৃতির অন্যতম একটি অংশ হিসেবে উপস্থাপন করা হয়।
- বর্তমানে আদিম অর্থনৈতিক ব্যবস্থাকে অধ্যয়নের পাশাপাশি নগর অর্থনৈতিক জীবনসহ সব ধরনের ব্যবস্থা নিয়ে অর্থনৈতিক নৃবিজ্ঞানে বিস্তারিত গবেষণা করে।
- উপজাতি বা ক্ষুদ্র নৃতাত্বিক গোষ্ঠীগুলোর সামাজিক-সাংস্কৃতিক কাঠামোকে বোঝার ক্ষেত্রে অর্থনীতির বিজ্ঞান একটি গুরুত্বপূর্ণ হাতিয়ার বা মাধ্যম হিসেবে কাজ করে।
……………………………………
লিখেছেন,
সাবা সাঈদ আল-আসাদ
শিক্ষার্থী, নৃবিজ্ঞান বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
[লেখাটির দায়ভার লেখক নিজে সংরক্ষণ করবেন]