(এই লেখাটি ব্রিটিশ ওয়েবসাইট www.theguardian.com এ প্রকাশিত প্রবন্ধ থেকে অনূদিত হয়েছে। প্রবন্ধটির ইংরেজি সংস্করণটি সম্পাদনা করেছেন Edward Gauvin। তিনি Gulbahar Haitiwaji ও Rozenn Morgat কর্তৃক রচিত মূল লেখা Rescapée du Goulag Chinois (Survivor of the Chinese Gulag) থেকে মূল অংশটি ইংরেজিতে অনুবাদ করেছেন। লেখাটিতে গল্পকারের নিজের ভাষায়, চীনা ‘পুনঃশিক্ষা’ শিবিরে অবস্থানকালীন সময়ের অভিজ্ঞতা বর্ণিত হয়েছে। প্রবন্ধের গল্পকার গুলবাহার হাইতিবাজি, চীনের জিনজিয়াং প্রদেশে বেড়ে উঠেছেন এবং পরবর্তীতে ফ্রান্সে দেশান্তরিত হয়েছেন। তিনি ২০১৭ থেকে ২০১৯ সাল পর্যন্ত চীনা পুনঃশিক্ষা শিবিরে বন্দি ছিলেন। মূলত তার এ অভিজ্ঞতা একজন উইঘুরের জাতিগত নিপীড়নের অভিজ্ঞতা। চীনে উইঘুর হচ্ছে একটি সংখ্যালঘু মুসলিম সম্প্রদায়। চীনের বিরুদ্ধে উইঘুর জাতিগোষ্ঠীর প্রতি বৈষম্যমূলক আচরণ, কঠোর নিয়ন্ত্রণ আরোপ, দাসে পরিণতকরণসহ পুণঃশিক্ষা শিবিরে নানাবিধ অজুহাতে আটকে রেখে নিপীড়নের অভিযোগ নানাসময়ই পত্রিকা এবং আন্তর্জাতিক মহলের আলোচনায় উঠে এসেছে।)
…………………………..
ফ্রান্সে দশ বছর বসবাসের পর, চীনে কিছু প্রয়োজনীয় কাগজপত্রে স্বাক্ষর করতে এসে আটকে পড়েছিলাম। পরবর্তী দুই বছর আমি অমানবিকতা সয়েছি, অপদস্ত হয়েছি এবং আমার মগজ ধোলাই হয়েছে।
ফোনে লোকটি জানিয়েছিল, সে তেল কোম্পানির জন্য কাজ করে, “মূলত, হিসাবরক্ষণে”। তার কণ্ঠটি আমার কাছে অপরিচিত ছিল। প্রথমে আমি স্পষ্টভাবে বুঝতে পারিনি তিনি কি বিষয়ে ফোন করেছিলেন। সময় তখন ২০১৬ সালের নভেম্বর; চীন ছেড়ে ১০ বছর আগে ফ্রান্সে চলে আসার সময় থেকেই, আমি এই কোম্পানি থেকে অবৈতনিক ছুটিতে ছিলাম। ফোনের লাইন স্পষ্ট না থাকায়, তার কথা শুনতে বেশ সমস্যা হচ্ছিল। তিনি বলেছিলেন, “ম্যাডাম হাইতিবাজি, আপনার আসন্ন অবসর সংক্রান্ত প্রয়োজনীয় দলিল স্বাক্ষর করতে আপনাকে অবশ্যই কারামায় ফিরে আসতে হবে”। কারামায় হচ্ছে পশ্চিম চীনা প্রদেশ জিনজিয়াংয়ের একটি শহর, যেখানে আমি তেলের কোম্পানিতে ২০ বছরেরও বেশি সময় কাজ করেছি। আমি তাকে বলেছিলাম, “সেক্ষেত্রে আমি পাওয়ার অফ অ্যাটর্নি দিতে চাই। কারামায় শহরে আমার এক বন্ধু আমার প্রশাসনিক বিষয়গুলো দেখাশোনা করে। কিছু কাগজপত্রের জন্য আমি কেন ফিরে আসব? কেন এই ছোটখাট বিষয়ের জন্য এতকিছু করতে হবে? এখনই কেন?” লোকটির কাছে আমার কথার কোন জবাব ছিল না। তিনি কেবল বলেছিলেন যে, আমার পক্ষ থেকে আমার বন্ধুকে দিয়ে কাজটি হবে কিনা তা তিনি আমাকে দুই দিনের মধ্যে জানাবেন।
২০০২ সালে, আমার স্বামী কেরিম কাজের সন্ধানে জিনজিয়াং ছেড়েছিলেন। তিনি প্রথমে কাজাখস্তানে চেষ্টা করেছিলেন, কিন্তু এক বছর পর হতাশ হয়ে ফিরে আসেন। তারপরে নরওয়েতে। তারপরে ফ্রান্স, যেখানে তিনি আশ্রয়ের জন্য আবেদন করেছিলেন। একবার তিনি সেখানে স্থায়ী হয়ে গেলে, আমাদের দুই মেয়ে এবং আমি তার কাছে চলে যেতাম।
কেরিম সবসময়ই জানত যে তিনি জিনজিয়াং ছেড়ে চলে যাবেন। আমাদের তেল কোম্পানিতে নিয়োগ দেওয়ার আগেই তার মাঝে চিন্তাটির ভিত তৈরী হয়েছিলো। জিনজিয়াং প্রদেশের বৃহত্তম শহর উরুমকিতে শিক্ষার্থী হিসেবে আমাদের দেখা হয়েছিলো এবং সদ্য গ্রাজুয়েট হিসাবে আমরা কাজ খুঁজতে শুরু করেছিলাম। তখন ১৯৮৮ সাল। সংবাদপত্রে চাকরির বিজ্ঞাপনগুলিতে প্রায়শই ছোট মুদ্রণে একটি ছোট বাক্যাংশ লেখা থাকত: কোনো উইঘুর নয়। এ বিষয়টি তাকে সবসময় তাড়া করে বেড়িয়েছে। আমাদের অনুসরণে সর্বত্র ছুটে চলা বৈষম্যের প্রমাণগুলিকে উপেক্ষা করতে চেষ্টা করার সময়, জিংজিয়াং ছাড়ার চিন্তাটি একটি ঘোরে পরিণত হয়েছিল।
¯œাতক শেষ হওয়ার পরে, আমাদের কারামায় শহরে তেল কোম্পানিতে ইঞ্জিনিয়ার হিসাবে চাকরির প্রস্তাব দেওয়া হয়েছিলো। আমরা ভাগ্যবান ছিলাম। তবে তখন ছিল লাল খাম পর্ব। লুনার নতুন বছরে যখন উর্ধ্বতন কর্মকর্তা বার্ষিক বোনাস দেয় তখন উইঘুর কর্মীদের দেওয়া লাল খামগুলিতে, চীনের প্রভাবশালী নৃতাত্তি¡ক গোষ্ঠী হানদের দেওয়া বেতনের চেয়ে কম টাকা ছিলো। শীঘ্রই, সমস্ত উইঘুরকে কেন্দ্রীয় অফিস থেকে সরিয়ে শহরের সীমানায় স্থানান্তরিত করা হয়। কিছু কর্মী আপত্তি জানিয়েছিল, কিন্তু আমি সাহস করি নি। কয়েক মাস পরে, যখন সিনিয়র পদে লোক নেওয়া হয়, তখন কেরিম আবেদন করেছিলো। তাঁর যথাযথ যোগ্যতা এবং প্রবীণত্ব ছিল। সিনিয়র পদটি না পাওয়ার কোনও কারণ ছিল না। কিন্তু পদটি একজন হান কর্মচারীকে দেওয়া হয় যার কাছে কোনো ইঞ্জিনিয়ারিং ডিগ্রিও ছিল না। ২০০০ সালে এক রাতে, কেরিম বাড়িতে এসে জানিয়ে দেয় যে, সে কাজ ছেড়ে দিয়েছে। সে বলেছিলো, “অনেক হয়েছে”।
আমার স্বামী যে অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে যাচ্ছিল, তা বেশ সুপরিচিত। ১৯৫৫ সালে যখন কমিউনিস্ট চীন জিনজিয়াংকে একটি “স্বায়ত্তশাসিত অঞ্চল” হিসাবে যুক্ত করেছিল, তখন থেকেই আমাদের উইঘুরদের মধ্য রাজ্যের কাঁটা (অবাঞ্ছিত) হিসেবে দেখা হত। জিনজিয়াং একটি সুকৌশলী স্থান এবং চীনের ক্ষমতাসীন কমিউনিস্ট দলের কাছে এটির নিয়ন্ত্রণ ধরে রাখা অনেক গুরুত্বপূর্ণ । এ কারণে দলটি “নতুন সিল্ক রোড” এ প্রচুর বিনিয়োগ করেছে; এটি মধ্য এশিয়ার মাধ্যমে চীনকে ইউরোপের সাথে সংযুক্ত করার জন্য পরিকল্পিত প্রকল্প, যার মধ্যে আমাদের অঞ্চলটি একটি গুরুত্বপূর্ণ অক্ষ। রাষ্ট্রপতি শি জিনপিংয়ের দুর্দান্ত পরিকল্পনার জন্য জিনজিয়াং অপরিহার্য অংশ- একটি শান্তিপূর্ণ জিনজিয়াং তাদের জন্য প্রয়োজনীয় যা ব্যবসায়ের জন্য উন্মুক্ত, বিচ্ছিন্নতাবাদী প্রবণতা এবং জাতিগত উত্তেজনা থেকে মুক্ত। সংক্ষেপে বললে, উইঘুর শূণ্য জিনজিয়াং।
জিনজিয়াং এক নজিরবিহীন অত্যাচারের যুগে প্রবেশের ঠিক আগে ২০০৬ সালের মে মাসে আমার মেয়েরা এবং আমি ফ্রান্সে আমার স্বামীর কাছে পালিয়ে এসেছিলাম। আমার ১৩ এবং ৮ বছর বয়সী মেয়েদেরকে তাদের বাবার মতো শরণার্থী পরিচয় দেওয়া হয়েছিল। আশ্রয় প্রার্থনায়, আমার স্বামী অতীতের সাথে বিচ্ছেদ করেছিল। ফরাসী পাসপোর্ট প্রাপ্তি পরিণামে তার চীনা জাতীয়তা কেড়ে নিয়েছিল। আমার কাছে আমার পাসপোর্ট ঘুরিয়ে দেওয়ার ফলাফল ভয়াবহ ছিলো: আমি কখনই জিনজিয়াং ফিরে যেতে পারব না। আমার বাবা-মা, ভাই-বোন, তাদের সন্তানদের, আমার শিকড়কে, প্রিয়জনদের কিভাবে আমি বিদায় জানাতে পারি? আমি আমার মায়ের কথা কল্পনা করেছিলাম, বহু বছর পর উত্তর পাহাড়ে তার গ্রামে তিনি একা মারা যাচ্ছেন। আমার চীনা জাতীয়তা ছেড়ে দেওয়া মানে তারও হাল ছেড়ে দেওয়া। আমি এটি করতে পারিনি। তাই এর পরিবর্তে, আমি আবাসিক অনুমতি চেয়ে আবেদন করেছিলাম যা প্রতি ১০ বছর পর পর নবায়নযোগ্য ছিলো।
ফোন কলের পরে, বোলগনে আমাদের অ্যাপার্টমেন্টের শান্ত ঘরটির চারপাশে তাকানোর সময় আমার মাথায় প্রশ্নগুলো ঘুরপাক খাচ্ছিল। লোকটি কেন আমাকে কারামায় ফিরিয়ে নিতে চায়? এটি কি কোনো চালাকি ছিলো, যাতে পুলিশ আমাকে জিজ্ঞাসাবাদ করতে পারে? ফ্রান্সে আমার চেনা কোনো উইঘুরের সাথে এর আগে এমনটা ঘটেনি।
লোকটি দু’দিন পরে ফোন করল। “পাওয়ার অফ অ্যাটর্নি প্রদান করা সম্ভব হবে না, ম্যাডাম হাইতিবাজি। আপনাকে অবশ্যই সশরীরে কারামায় আসতে হবে।” আমি রাজি হলাম। যাই হোক, এটি কেবল কয়েকটি নথির বিষয় ছিল।
আমি তাই বলেছিলাম “বেশ। আমি যত তাড়াতাড়ি সম্ভব সেখানে উপস্থিত থাকব।”
ফোন রাখার পর, আমার মেরুদন্ড বেয়ে শিহরণ বয়ে গেলো। জিনজিয়াং এ যাওয়া নিয়ে আমি ভয়ে ছিলাম। ২ দিন ধরে কেরিম আমাকে আশ^স্ত করার চেষ্টা করে যাচ্ছিল, কিন্তু এ বিষয়ে আমার খারাপ আশঙ্কাই ছিলো। বছরের এ সময়ে কারামায় শহর তীব্র শীতের কবলে ছিলো। বরফ বাতাসের ঝর্না, দোকান, বাড়িঘর এবং অ্যাপার্টমেন্টের ভবনগুলোতে আর্তনাদ তৈরী করেছিলো। কিন্তু আমি জিনজিয়াং এর কঠোর ব্যবস্থা নিয়ে সবচেয়ে বেশি ভয়ে ছিলাম। ঘরের বাইরে পা রাখলেই, যে কেউ বিনা কারণে গ্রেপ্তার হতে পারত।
বিষয়টি নতুন ছিল না, তবে ২০০৯ সালে উরুমকি দাঙ্গার পর থেকে এই স্বৈরশাসন আরও প্রকট হয়ে উঠেছে। শহরটির উইঘুর এবং হান জনগোষ্ঠীর মধ্যে সহিংসতার একটি বিস্ফোরণ ঘটেছিল, যেখানে ১৯৭ জন মারা গিয়েছিল। ঘটনাটি এ অঞ্চলের সা¤প্রতিক ইতিহাসের একটি গুরুত্বপূর্ণ মোড়। পরবর্তীতে, চীনা কমিউনিস্ট পার্টি এই ভয়াবহ কাজগুলোর জন্য পুরো উইঘুর জাতিগোষ্ঠীকে দোষারোপ করে এবং উইঘুর পরিবারগুলোকে র্যাডিকাল ইসলাম এবং বিচ্ছিন্নতাবাদের এক আস্তানা হিসেবে দাবি করার মাধ্যমে দমনমূলক নীতিসমূহকে ন্যায্যতা দেয়।
২০১৬ সালের গ্রীষ্মের সময়টিতে আমাদের জাতি গোষ্ঠী এবং কমিউনিস্ট পার্টির দীর্ঘ লড়াইয়ে, একজন উল্লেখযোগ্য নতুন খেলোয়াড়ের প্রবেশ ঘটেছিল। চীন কোয়াঙ্গুও, যিনি তিব্বতে কঠোর নজরদারি ব্যবস্থা চাপিয়ে দিয়ে খ্যাতি অর্জন করেছিলেন, তাকে জিনজিয়াং প্রদেশের প্রধান নির্বাচিত করা হয়েছিল। তাঁর আগমনে, উইঘুরদের দমন নাটকীয়ভাবে বেড়ে যায়। প্রায় রাতেই হাজার হাজার মানুষকে মরুভূমির বসতিগুলির প্রান্তের “স্কুলগুলিতে” পাঠানো হত। এগুলো “শিক্ষার মাধ্যমে রূপান্তর” শিবির হিসাবে পরিচিত ছিল। বন্দীদের ব্রেইনওয়াশ করার জন্য সেখানে পাঠানো হয়েছিল – এবং আরও খারাপ উদ্দেশ্যে।
আমি ফিরে যেতে চাইনি, তবে সবসময়ের মতো আমি সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম যে, কেরিম ঠিক; আমার চিন্তার কোনও কারণ নেই। এই যাত্রায় কয়েক সপ্তাহ সময় লাগত। “তারা অবশ্যই তোমাকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য টানবে, তবে আতঙ্কিত হবে না। এটা সম্পূর্ণ স্বাভাবিক, সে আমাকে আশ্বস্ত করেছিলো। আমি চীনে পৌঁছানোর কয়েক দিন পরে, ৩০ নভেম্বর ২০১৬ সালে, আমার আসন্ন অবসর সম্পর্কিত ডকুমেন্টগুলিতে স্বাক্ষর করতে কারামায় তেল কোম্পানির অফিসে গিয়েছিলাম। অফিসে এর ঝলকানো দেওয়ালগুলির সাথে অ্যাকাউন্ট্যান্ট বসেছিল, ছিলো একজন খিটখিটে স্বরের হান এবং পর্দার পেছনে তার একজন কর্কশ সেক্রেটারি।
পরবর্তী ঘটনাটি কোম্পানির প্রধান কার্যালয় থেকে ১০ মিনিটের দূরত্বে কুনলুন থানায় ঘটেছিল। পথে, আমাকে যে প্রশ্নগুলো জিজ্ঞাসা করা হতে পারে সেসবের উত্তর প্রস্তুত করে নিয়েছিলাম। আমি নিজেকে শক্ত করার চেষ্টা করেছিলাম। সামনের ডেস্কে আমার জিনিসপত্র রেখে যাওয়ার পরে আমাকে একটি সরু, প্রাণহীন, জিজ্ঞাসাবাদের ঘরে নিয়ে যাওয়া হয়। আমি আগে কখনও সেখানে যাই নি। একটি টেবিলের একপাশে আমি এবং অপরপাশে দু’জন পুলিশ ছিলেন। দৃশ্যপট এমন ছিলো যে, হিটারের শান্ত হাম, কোনোরকমে পরিষ্কার করা হোয়াইটবোর্ড এবং ম্লান আলোকসজ্জা। আমি ফ্রান্সে চলে যাওয়ার কারণ, প্যারিসের ব্যবসায়িক জেলা লা ডাইফেন্সের একটি বেকারি এবং একটি ক্যাফেটেরিয়ায় আমার চাকরি নিয়ে আলোচনা করেছিলাম।
তারপরে একজন অফিসার আমার নাকের নীচে একটি ছবি ধরলেন। ছবিটি দেখে আমার রক্ত গরম হয়ে ওঠে। ছবির মুখটিকে আমি নিজের হিসাবেও জানতাম – সেই পূর্ণ গাল, সেই সরু নাক। এটা ছিল আমার মেয়ে গুলহুমার। সে প্যারিসের প্লেস ডু ট্রোকাডেরোর সামনে দাঁড়িয়ে ছিলো, তার পরনে ছিলো কালো রঙের জামা, যেটি আমি তাকে দিয়েছি। ছবিতে সে হাসছে, তার হাতে একটি ক্ষুদ্র পূর্ব তুর্কিস্তান পতাকা, একটি পতাকা যা চীন সরকার নিষিদ্ধ করেছিল। উইঘুরদের কাছে, পতাকাটি এই অঞ্চলের স্বাধীনতা আন্দোলনের প্রতীক। ওয়ার্ল্ড উইঘুর কংগ্রেসের ফরাসী শাখা আয়োজিত বিক্ষোভগুলির মধ্যে একটি ছিল এই অনুষ্ঠান, যা নির্বাসনে উইঘুরদের প্রতিনিধিত্ব করে এবং জিনজিয়াংয়ে চীনা নিপীড়নের বিরুদ্ধে কথা বলে।
আপনি রাজনৈতিক হোন বা না হোন, ফ্রান্সে এই জাতীয় সমাবেশ স¤প্রদায়ের পক্ষে একত্রিত হওয়ার জন্য একটা সুযোগ, অনেকটা জন্মদিন, ইদ এবং নওরোজের বসন্ত উৎসবের মতো। আপনি চাইলে জিনজিয়াংয়ের নিপীড়নের প্রতিবাদ করতে যেতে পারেন, তবে গুলহুমারের মত বন্ধুদের দেখতে এবং নির্বাসিত স¤প্রদায়ের দেখা পেতেও যেতে পারেন। সেই সময়, কেরিম পরিচারক ছিল। মেয়েরা একবার বা দু’বার গিয়েছিল। আমি কখনো করিনি, রাজনীতি আমার জিনিস নয়। জিনজিয়াং ছেড়ে যাওয়ার পরে, আমার আগ্রহ কমে গিয়েছিল।
হঠাৎ টেবিলে অফিসারটি জোরে ঘুষি মারে।
“আপনি তাকে চেনেন, তাই না?”
“হ্যাঁ, ও আমার মেয়ে।”
“আপনার মেয়ে সন্ত্রাসী!”
“না। ও কেন এই বিক্ষোভে এসেছিলো তা আমি জানি না।”
আমি পুনরাবৃত্তি করতে থাকি, ‘আমি জানি না, আমি জানি না, সে সেখানে কী করছে, সে কোন ভুল করছে না, কসম! আমার মেয়ে সন্ত্রাসী নয়! আমার স্বামীও নয়!’ বাকি জিজ্ঞাসাবাদের কথা মনে পড়ছে না। যা মনে পড়ছে তা হ’ল সেই ফটো, তাদের আক্রমণাত্মক প্রশ্ন এবং আমার নিষ্ফল জবাব। আমি জানি না এসব কতক্ষণ ধরে চলেছিল। আমার মনে আছে এসব শেষ হয়ে গেলে, আমি বিরক্ত হয়ে বলেছিলাম,
“আমি এখন যেতে পারি? আমাদের কাজ কি এখানে শেষ?” তারপরে একজন বলেছিলেন;
“না, গুলবাহার হাইতিবাজি, আমরা শেষ করিনি।”
‘ডান! বাম! স্বাচ্ছন্দ্যে !’ ঘরে আমরা ৪০ জন মহিলা ছিলাম, সবাই নীল পায়জামা পরে ছিলো। এটি একটি অ-বিবরণীয় আয়তক্ষেত্রাকার শ্রেণিকক্ষ ছিল। ক্ষুদ্র ছিদ্রযুক্ত একটি বড় ধাতব শাটার, যা আলোকে এমনভাবে প্রবেশ করতে দেয় যেনো আমাদের থেকে বাইরের বিশ্ব লুকিয়ে থাকে। দিনের এগারো ঘন্টা, পৃথিবী এই কক্ষে সংকুচিত হয়ে পড়েছিল। আমাদের চপ্পলগুলি লিনোলিয়ামে চেপে গেছে। দু’জন হান সেনা আমাদের রুমে প্রবেশের সময় নিরলসভাবে সময় তদারকি করত। এটাকে বলা হত ‘শারীরিক শিক্ষা’। বাস্তবে, এটি ছিল সামরিক প্রশিক্ষণের সমতুল্য।
আমাদের ক্লান্ত দেহগুলো সমতালে পিছনে, একপাশে, কোনাকুনি চলছিল। সৈনিক যখন বলছিলো “স্বাচ্ছন্দ্যে!” আমাদের বন্দিদের দল হিমশীতল হয়ে পড়ছিলো। তিনি আমাদের স্থির থাকার নির্দেশ দিয়েছিলেন। এটি আধা ঘন্টা বা ঠিক প্রায় পুরো ঘন্টা বা আরও বেশি সময় ধরে থাকতে পারে। এটা হয়ে গেলে, আমাদের পা গুলো তীব্র যন্ত্রণায় কাঁপতে শুরু করত। আমাদের দেহ এখনও উষ্ণ এবং অস্থির, আর্দ্র উত্তাপে আন্দোলিত না হওয়ার জন্য লড়াই করছিল। আমরা আমাদের নিজস্ব নির্বোধ নিঃশ্বাসের গন্ধ পাচ্ছিলাম। আমরা গবাদি পশুর মতো হাঁপাচ্ছিলাম। কখনও কখনও, আমাদের মধ্যে দু একজন অজ্ঞান হবার উপক্রম হচ্ছিল। যদি সে না উঠত, একজন প্রহরী তাকে পায়ে ধরে হেচকা টান দিত নয়ত জাগিয়ে তুলতে চড় মারত। যদি সে আবার পড়ে যেত, তবে একজন প্রহরী তাকে ঘর থেকে টেনে নিয়ে যেত এবং আমরা তাকে আর কখনও দেখতে পেতাম না। কখনও না। প্রথমদিকে, এটি আমাকে চমকে দিয়েছিল, তবে পরে আমি অভ্যস্ত হয়ে পড়েছিলাম। আপনি যে কোন কিছুতে অভ্যস্ত হতে পারেন, এমনকি আতঙ্কেও।
তখন ছিলো জুন ২০১৭, আমি এখানে তিন দিনের জন্য ছিলাম। কারামায় পুলিশ কক্ষে প্রায় পাঁচ মাস ধরে জিজ্ঞাসাবাদ এবং নির্মম আচরণের এক পর্যায়ে আমাকে ২৯ দিনের জন্য সাজা হিসাবে বিছানায় বেঁধে রাখা হয়েছিল, যদিও আমি কিছুই জানতাম না। আমাকে বলা হয়েছিল যে আমি স্কুলে যাব। আমি এই রহস্যময় স্কুলগুলো বা তাদের দেওয়া কোর্সগুলোর কথা কখনও শুনিনি। আমাকে বলা হয়েছিল যে উইঘুরদের “সংশোধন” করতে সরকার সেগুলো তৈরি করেছে। আমার সেল ভাগ করে নেওয়া মহিলাটি বলেছিলেন, এটি হান শিক্ষকদের সাথে একটি সাধারণ বিদ্যালয়ের মতো হবে। তিনি বলেছিলেন যে, শিক্ষার্থীরা একবার পাস করার পরে বাড়ি ফিরতে পারবে।
এই “স্কুল” ছিল কারামায়ের উপকণ্ঠে একটি জেলা বৈজিয়ন্তানে। পুলিশ কক্ষ ছেড়ে যাওয়ার পরে, আমি শুকনো খাদে আটকে থাকা একটি চিহ্ন থেকে (যেখানে খালি কয়েকটি প্লাস্টিকের ব্যাগ প্রবাহিত হচ্ছিল) সমস্ত তথ্য সংগ্রহ করতে পেরেছিলাম। স্পষ্টতই, প্রশিক্ষণটি পনেরো দিন চলার কথা ছিল। এর পরে, তত্তে¡র উপর ক্লাস শুরু হবে। আমি জানতাম না কীভাবে আমি নিজেকে ধরে রেখেছিলাম। আমি কীভাবে ইতিমধ্যে ভেঙে পড়ি নি! বৈজয়ন্তানে কোনও মানুষের ব্যক্তিগত জমি ছিল না। সেখানে তিনটি বিল্ডিং উঠেছিল, প্রতিটিই একটি ছোট বিমানবন্দরের সমান। কাঁটাতারের বেড়া পেরিয়ে চোখের সামনে যতদূর দেখা যায় মরুভূমি ছাড়া আর কিছুই ছিল না।
প্রথম দিনে, মহিলা রক্ষীরা আমাকে বিছানা পূর্ণ একটি ছাত্রাবাসে নিয়ে গিয়েছিল। বিছানাগুলো সংখ্যা দিয়ে চিহ্নিত কাঠের তক্তা। সেখানে ইতিমধ্যে অন্য একজন মহিলা ছিলেন; নাদিরা, বাঙ্ক নং ৮। আমাকে বাঙ্ক নং ৯ এ রাখা হয়েছিল। নাদিরা আমাকে ছাত্রাবাসের আশপাশ টা দেখিয়েছিল, এতে কাঁচা রঙের গন্ধ ছিল। কাজের জন্য বালতি, যা সে ক্রোধের সাথে লাথি মেরেছিল; ধাতব শাটারযুক্ত জানালাটি সর্বদা বন্ধ থাকত; ঘরের উঁচু কোণে দুটি ক্যামেরা পিছনে পিছনে চলছে। এটুকুই। গদি নেই। আসবাব নেই। টয়লেট পেপার নেই। কোনও চাদর নেই। বেসিন নেই। কেবল হতাশায় নিমজ্জিত আমরা দু’জন এবং সেলের ভারী দরজা বন্ধ করার জোড়ালো শব্দ।
এটি কোন স্কুল ছিল না। এটি ছিল সামরিক নিয়মাবলী সম্পন্ন এবং আমাদের দমন করার জন্য একটি পুনঃশিক্ষা শিবির। নীরবতা আরোপ করা হয়েছিল, তবে শারীরিক সীমাবদ্ধতার কারণেও আমাদের কথা বলতে ইচ্ছে করে নি। সময়ের সাথে সাথে, আমাদের কথোপকথনগুলি ক্ষীণ হয়ে এসেছিল। আমাদের ঘুম ভাঙা, খাদ্য গ্রহণ, রাতে ঘুমাতে যাওয়া সব চলত হুইসেলের শব্দে। গার্ডদের সর্বদা আমাদের ওপর নজর ছিল; তাদের নজর থেকে বাঁচার কোনও উপায় ছিল না, প্রার্থনার অভিযোগের ভয়ে ফোঁসানো বা মুখ মোছার কোনও উপায় ছিল না। “ইসলামপন্থী সন্ত্রাসবাদী” আখ্যা দেওয়ার ভয়ে খাবারকে প্রত্যাখ্যান করা নিয়মের বিরুদ্ধে ছিল। ওয়ার্ডেনরা দাবি করেছিল যে আমাদের খাবার হালাল।
রাতে, আমি আমার বিছানায় নিশ্চল হয়ে পড়ে থাকতাম। আমি সময়ের সমস্ত জ্ঞান হারিয়েছিলাম। কোনও ঘড়ি ছিল না। দিনের ঠান্ডা বা গরম কতটা অনুভূত হয়েছিল তা থেকে সময় অনুমান করেছিলাম। প্রহরীরা আমাকে আতঙ্কিত করে রেখেছিল। এখানে আসার পর থেকে আমরা দিবালোক দেখিনি – সব জানালা সেই জঘন্য ধাতব শাটার দ্বারা অবরুদ্ধ করা হয়েছিল। যদিও পুলিশ সদস্যদের মধ্যে একজন আমাকে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল যে আমাকে একটি ফোন দেওয়া হবে, তবে হয়নি। কে জানত যে আমাকে এখানে রাখা হচ্ছে? আমার বোনকে কি অবহিত করা হয়েছিল, অথবা কেরিম কিংবা গুলহুমারকে? এটি একটি জেগে ওঠা দুঃস্বপ্ন ছিল। সুরক্ষা ক্যামেরাগুলির দৃষ্টির নীচে আমি আমার সাথে থাকা বন্দীদের কাছেও মুক্ত হতে পারি নি। আমি ক্লান্ত ছিলাম, ভীষণ ক্লান্ত ছিলাম। আমি আর ভাবতে পারছিলাম না।
শিবিরটি ছিল একটি গোলকধাঁধা যেখানে রক্ষীরা আমাদেরকে ছাত্রাবাস থেকে দলে দলে নিয়ে যায়। ঝরনা, বাথরুম, শ্রেণিকক্ষ বা ক্যান্টিনে যাওয়ার পথে পাহারায় ছিলাম। এমনকি এক মুহুর্তের গোপনীয়তাও অসম্ভব ছিল। হল পথের উভয় প্রান্তে, স্বয়ংক্রিয় সুরক্ষা দরজা বিমানের মতো গোলকধাঁধাটিকে সিল করে দেয়। একটি জিনিস নিশ্চিত ছিল; এখানে সবকিছু নতুন ছিল। দাগহীন দেয়াল থেকে পেইন্টের গন্ধ একটি চিহ্ন ছিল যে এখানে সব নতুন। এটি একটি কারখানার প্রাঙ্গণের মতো মনে হয়েছিল (পরে আমি জানতে পারি এটি একটি পুনঃর্নির্মাণ পুলিশ প্রাঙ্গন) তবে এটি কতটা বড় তা সম্পর্কে তখনও আমার কোনও সুস্পষ্ট ধারণা ছিল না।
আশেপাশে চলাচলের সময় আমি যে প্রহরী এবং অন্যান্য মহিলা বন্দীদের পাশ কাটিয়েছি তার পরিসংখ্যান আমাকে বিশ্বাস করতে বাধ্য করেছিল যে এই শিবিরটি বিশাল। প্রতিদিন আমি নতুন মুখ, জম্বি-জাতীয়, চোখের নীচে ফোলা এমন দেখতে পেতাম। প্রথম দিন শেষে, আমাদের ঘরে আমরা সাতজন উপস্থিত ছিলাম; তিন দিন পরে ১২ জন ছিলাম। সামান্য দ্রুত হিসেব; আমার সেলসহ সহ ১৬ টি সেল গ্রুপ গণনা করেছি, যার মধ্যে ১২ টি করে বাঙ্ক রয়েছে, যা প্রায় ২০০ জনকে বৈজিয়ন্তানে বন্দী করেছে। পরিবার থেকে ছেড়ে দু’শ মহিলা। পরবর্তী নির্দেশ না দেওয়া পর্যন্ত দুই শতাধিক লোকের জীবন অবরুদ্ধ এবং শিবিরটি কেবল ভরাট হয়ে চলছিল।
আপনি নতুন আগতদের তাদের বিরক্তিকর মুখ দেখেই চিনতে পারতেন। তারা তখনও হলওয়েতে চোখে চোখ রাখার চেষ্টা করছিল। যারা সেখানে আগে থেকে ছিলো তারা তাদের পায়ের দিকে নীচে তাকিয়ে ছিল। তারা রোবটের মতো কাছাকাছি জায়গায় ঘুরে বেড়াত। কোনও হুইসেল তাদের নির্দেশ দিলে তারা কোনো নজর না দিয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করত। ঈশ্বর, তাদের সেভাবে তৈরি করার জন্য কী করা হয়েছিল?
ভেবেছিলাম তত্ত্বের ক্লাসগুলি শারীরিক প্রশিক্ষণ থেকে আমাদের কিছুটা স্বস্তি এনে দেবে, তবে সেসব আরও খারাপ ছিল। শিক্ষক সর্বদা আমাদের দেখছিলেন, এবং তিনি যতবার সুযোগ পেলেন আমাদের চড় মারলেন। একদিন, আমার এক সহপাঠী, ষাটের দশকের এক মহিলা, চোখ বন্ধ করে ছিলেন, অবশ্যই ক্লান্তি বা ভয় থেকে। শিক্ষক তাকে নির্মমভাবে চড় মারলেন। “ভেবেছো আমি তোমাকে প্রার্থনা করতে দেখছি না? তোমাকে শাস্তি দেওয়া হবে!” রক্ষীরা তাকে ঘর থেকে হিংস্রভাবে টেনে নিয়ে যায়। এক ঘন্টা পরে, তিনি নিজের লেখা কিছু নিয়ে ফিরে এসেছিলেন; তার আত্ম-সমালোচনা। শিক্ষক আমাদের কাছে এটি উচ্চস্বরে পড়তে বাধ্য করেছিলেন। তিনি মান্য করলেন, তার বিবর্ন মুখমন্ডল, তারপর আবার বসলেন। সে যা করেছে তা তার চোখ বন্ধ করে দিয়েছিল।
কিছু দিন পরে, আমি বুঝলাম লোকেরা “ব্রেইন ওয়াশিং” বলতে কী বোঝায়। প্রতিদিন সকালে, উইঘুর প্রশিক্ষক আমাদের নীরব শ্রেণিকক্ষে আসতেন। আমাদের নিজস্ব জাতিগোষ্ঠীর একজন মহিলা শেখাতেন কীভাবে চাইনিজ হয়ে উঠতে হয়। তিনি আমাদের সাথে পথভ্রষ্ট নাগরিকদের মতো আচরণ করেছিলেন যাদের পুনরায় শিক্ষিত করতে হবে। আমি বিস্মিত হয়েছিলাম যে, সে কি ভেবেছিল এসব নিয়ে! আদৌ কি সে কিছু ভেবেছিল? কোথা থেকে সে এসেছিলো? সে এখানে কীভাবে এসে পৌছালো? এই কাজটি করার আগে সে কি নিজেই পুনরায় শিক্ষিত হয়েছিলো?
তার ইশারায়, আমরা সবাই একসাথে দাঁড়িয়ে যেতাম। “Lao shi hao!” শিক্ষককে এই অভিবাদনটি প্রতিদিনের ১১ ঘন্টা পাঠদানের সময় জানাতে হত। আমরা চীনের প্রতি এক প্রকার আনুগত্যের পুনরাবৃত্তি করেছিলাম; “আমাদের মহান দেশকে ধন্যবাদ। আমাদের পার্টি আপনাকে ধন্যবাদ। আমাদের প্রিয় রাষ্ট্রপতি শি জিনপিংকে ধন্যবাদ জানাই।” সন্ধ্যায়, একটি অনুরূপ সংস্করণের মাধ্যমে পাঠদান শেষ হত; “আমি আমার মহান দেশের উন্নতি এবং উজ্জ্বল ভবিষ্যত প্রত্যাশা করি। আমি চাই সকল জাতিগোষ্ঠী একটি একক মহান জাতিরাষ্ট্র গঠন করবে। আমি রাষ্ট্রপতি শি জিনপিংয়ের সুস্বাস্থ্য কামনা করছি। দীর্ঘজীবী হোন রাষ্ট্রপতি শি জিনপিং।”
আমাদের চেয়ারগুলোতে আটকে থেকে, আমরা তোতা পাখির মতো আমাদের পাঠগুলি পুনরাবৃত্তি করেছিলাম। তারা আমাদেরকে চীনের গৌরবময় ইতিহাস শিখিয়েছিল – একটি স্যানিটাইজড সংস্করণ, যা নিপীড়নের শুদ্ধ রূপ। আমাদের দেওয়া ম্যানুয়ালটির প্রচ্ছদে “পুনঃশিক্ষা প্রোগ্রাম” লেখা ছিল। এতে শক্তিশালী রাজবংশ এবং তাদের গৌরবময় বিজয় এবং কমিউনিস্ট পার্টির দুর্দান্ত সাফল্যের গল্প ছাড়া কিছুই ছিল না। এটি চীনা বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে শিক্ষার চেয়ে আরও বেশি রাজনীতিক ও পক্ষপাতদুষ্ট ছিল। প্রথম দিনগুলিতে, এটি আমাকে হাসাত। তারা কি সত্যিই ভেবেছিল যে কয়েক পৃষ্ঠার প্রচারের মাধ্যমে তারা আমাদের মনোবল ভেঙে ফেলবে? কিন্তু দিন যেতে যেতে পুরানো শত্রুর মতো ক্লান্তি ভর করতে থাকল। আমি ক্লান্ত হয়ে পড়েছিলাম, এবং প্রতিরোধ করার জন্য আমার দৃঢ় সংকল্প স্থায়ীভাবে অনড় ছিলো। আমি হাল না ছাড়ার চেষ্টা করেছিলাম, তবে স্কুলে স্টিম্রোলিং চলছে। এটি ঠিক আমাদের সকল যন্ত্রণা দেহের উপরে গড়িয়ে পড়ে। তবে এটি ছিল ব্রেইন ওয়াশিং – পুরো দিন একই মতাদর্শিক বাক্যাংশ পুনরাবৃত্তি করতে ব্যয় করা হত। যেন এগুলো পর্যাপ্ত ছিল না, আমাদের ঘুমাতে যাওয়ার আগে, রাতের খাবারের পরে আরও এক ঘন্টা অতিরিক্ত অধ্যয়ন করতে হত। আমরা শেষবারের মতো আমাদের অবিরাম পুনরাবৃত্তিকৃত পাঠগুলো পর্যালোচনা করতাম। প্রতি শুক্রবার, আমাদের মৌখিক এবং লিখিত পরীক্ষা ছিল। ঘুরেফিরে, শিবির নেতাদের সতর্ক চোখের নীচে, আমরা তাদের পরিবেশিত কমিউনিস্ট স্টু আবৃত্তি করতাম। এইভাবে, আমাদের স্বল্প-মেয়াদী স্মৃতি একইসাথে আমাদের সর্বশ্রেষ্ঠ বন্ধু এবং আমাদের নিকৃষ্টতম শত্রু হয়ে উঠল। এটি আমাদের ইতিহাসের খন্ড এবং অনুগত নাগরিকত্বের ঘোষণাকে পুনরায় ধারণ করতে সক্ষম করেছিল, যাতে আমরা শিক্ষকের দ্বারা প্রকাশ্যে অপমান এড়াতে পারি। তবে একই সাথে এটি আমাদের সমালোচনামূলক ক্ষমতা দুর্বল করে দিত। এটি সেই স্মৃতি এবং চিন্তা কেড়ে নিয়েছিলো যা আমাদের জীবনের সাথে বেঁধে রাখে। কিছুক্ষণ পরে আমি আর কেরিম এবং আমার কন্যাদের মুখ পরিষ্কারভাবে দেখতে পেলাম না। আমরা বোবা প্রাণী না হওয়া পর্যন্ত আমাদের কাজ চলছিল। এটি কতদিন চলত তা কেউ আমাদের জানায় নি।
এমনকি জিনজিয়াংয়ের কিসের মধ্য দিয়ে গেছি সে গল্প কিভাবে শুরু করা যায়? আমার প্রিয়জনকে কীভাবে বলা যায় যে আমি পুলিশি সহিংসতার মধ্যে বাস করেছি, তাদের ইউনিফর্ম মর্যাদার কারণে তারা আমাদের দেহ এবং মনের সাথে যা ইচ্ছে তাই করেছিল? যাদের মস্তিষ্ক পুরোপুরি ধুয়ে গিয়েছিল – সেই মানবতাবিহীন রোবট, হিংসাত্মক ভাবে আদেশ জারি করে এমন একটি ব্যবস্থার অধীনে কাজ করছিলো যেখানে, যারা অন্যদের নিন্দা করে না তারা নিজেরাই নিন্দিত হয় এবং যারা অন্যকে শাস্তি দেয় না তারা নিজেরাই শাস্তি পায়। প্রবৃত্তি এমন ছিলো যেনো আমরা পিটিয়ে মেরে ফেলার মতো শত্রু ছিলাম – বিশ্বাসঘাতক এবং সন্ত্রাসী – তারা আমাদের স্বাধীনতা কেড়ে নিয়েছিল। তারা আমাদের পৃথিবী থেকে দূরে, শিবিরে পশুর মতো আটকে রেখেছিলো।
“শিক্ষার-মাধ্যমে-রূপান্তর” শিবিরগুলিতে, অন্য স্থানের মত জীবন এবং মৃত্যুর অর্থ একই নয়। আমি একশ বারের বেশি ভেবেছিলাম, রাতে যখন প্রহরীদের পদচারণা আমাদের জাগিয়ে তুলত, আমাদের হয়ত মুক্ত করার সময় এসেছিল। আমার হাতের খুলি জুড়ে যখন কোনও হাত ক্লিপারগুলি ঠেলে দিলো, এবং অন্য হাতগুলি আমার কাঁধে পড়ে যাওয়া চুলের গুচ্ছ টান দিলো, তখন আমি চোখ বন্ধ করে ছিলাম, অশ্রু নিয়ে ঝাপসা চোখে ভাবলাম, আমার শেষ নিকটে এসে পড়েছে, আমাকে ফাঁসির মঞ্চের জন্য প্রস্তুত করা হচ্ছে। প্রতিটি কোণে মৃত্যু লুকিয়ে ছিলো। নার্সরা যখন আমাকে “টিকা দেওয়ার” জন্য আমার বাহুটি ধরল, তখন আমি ভেবেছিলাম তারা আমাকে বিষ দিচ্ছে। বাস্তবে, তারা আমাদের নির্জীব করছিল। আমি তখন শিবিরগুলির পদ্ধতিটি বুঝতে পেরেছিলাম, কৌশলটি বাস্তবায়িত হচ্ছে; তাদের উদ্দেশ্য ঠান্ডা মাথায় আমাদের হত্যা করা নয়, বরং আস্তে আস্তে আমাদের অদৃশ্য করা। এত আস্তে আস্তে যে, কেউ খেয়াল করবে না।
আমরা কে ছিলাম তা অস্বীকার করার আদেশ দেওয়া হয়েছিল। আমাদের নিজস্ব ঐতিহ্য, আমাদের বিশ্বাসের উপর থুতু দেওয়ার জন্য। আমাদের ভাষার সমালোচনা করার জন্য। আমাদের নিজের লোককে অপমান করার জন্য। আমার মতো মহিলারা, যারা শিবিরগুলোতে ছিল, তারা আর আগের মত নেই, যা আমরা একসময় ছিলাম। আমরা ছায়া; আমাদের আত্মা মারা গেছে। আমাকে বিশ্বাস করানো হয়েছিল যে আমার প্রিয়জনরা, আমার স্বামী এবং আমার মেয়ে সন্ত্রাসী। আমি এত দূরে ছিলাম, একা ছিলাম, এত ক্লান্ত ও বিচ্ছিন্ন ছিলাম যে আমি প্রায় এটি বিশ্বাস করেই ক্ষান্ত হয়েছিলাম। আমার স্বামী, কেরিম, আমার মেয়ে গুলহুমার এবং গুলনিগর – আমি তোমাদের “অপরাধ” এর নিন্দা করেছি। আমি কমিউনিস্ট পার্টির থেকে নৃশংসতার জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করেছি যা তোমরা বা আমি করিই নি। আমি যা বলেছি তা তোমাদের অসম্মানিত করেছে বলে আমি দুঃখিত। আজ আমি বেঁচে আছি, এবং আমি সত্য প্রচার করতে চাই। তোমরা আমাকে গ্রহণ করবে কিনা তা আমি জানি না, তোমরা আমাকে ক্ষমা করবে কিনা তা আমি জানি না। এখানে কী ঘটেছিল তা আমি কীভাবে তোমাদের বলতে শুরু করব?
আমি দু’বছর ধরে বৈজিয়ন্তানে ছিলাম। সেই সময়ে, আমার চারপাশের প্রত্যেকে – পুলিশ অফিসার যারা বন্দীদের জিজ্ঞাসাবাদ করতে এসেছিল, তাদের সাথে আরও রক্ষী, শিক্ষক – আমাকে সেই মিথ্যা বিশ্বাস করানোর চেষ্টা করেছিল যা ছাড়া চীনা পুনঃশিক্ষার প্রকল্পকে ন্যায়সঙ্গত করতে পারত না: সেটি হচ্ছে, উইঘুররা সন্ত্রাসবাদী, এবং এইভাবে যে আমি, গুলবাহার উইঘুর হিসাবে ১০ বছর ধরে ফ্রান্সে নির্বাসিত জীবন কাটাচ্ছিলাম, এজন্য আমি সন্ত্রাসী। প্রচারণার ঢেউ আমার উপর ধ্বসে পড়েছিল এবং মাসগুলি যেতে যেতে আমি আমার বিচক্ষণতা হারাতে শুরু করেছিলাম। আমার আত্মা টুকরো টুকরো হয়ে গিয়েছিল। আমি এসব কখনই সেরে উঠতে পারব না।
পুলিশ কর্তৃক সহিংস জিজ্ঞাসাবাদ চলাকালীন, আমি মারধরের শিকার হয়েছি – এতোটাই যে আমি মিথ্যা স্বীকারোক্তিও দিতাম। তারা আমাকে বোঝাতে সক্ষম হয়েছিল যে যত তাড়াতাড়ি আমি আমার অপরাধ স্বীকার করব, তত তাড়াতাড়ি আমি ছাড়া পাব । ক্লান্ত হয়ে শেষ পর্যন্ত আমি আত্মসমর্পণ করেছি এবং আমার আর কোনও উপায় ছিল না। কেউ চিরকাল তাদের বিরুদ্ধে লড়াই করতে পারে না। আপনি যতই অক্লান্তভাবে মগজ ধোলাইয়ের বিরুদ্ধে লড়াই করেন না কেন, এটি তার কাজ করে ফেলে। সমস্ত ইচ্ছা এবং আবেগ আপনাকে ত্যাগ করে। আপনার জন্য আর বিকল্প অপশন কি থাকে? একটি ধীর, বেদনাদায়ক মৃত্যু বা নতিস্বীকার। আপনি যদি নতিস্বীকার করেন, যদি আপনি পুলিশের বিরুদ্ধে আপনার মনস্তাত্তি¡ক শক্তি সংগ্রামকে হারাতে দেখেন তবে কমপক্ষে, এত কিছুর পরেও, যে জ্ঞান আপনাকে মনে করিয়ে দেবে আপনি কে, তাতে আপনি লেগে থাকবেন।
আমি তাদের যা বলছিলাম তার একটি শব্দও আমি বিশ্বাস করি নি। আমি কেবল একজন ভাল অভিনেতা হওয়ার জন্য যথাসাধ্য চেষ্টা করেছি। ২ আগস্ট ২০১৯ এ, একটি সংক্ষিপ্ত বিচারের পরে, মাত্র কয়েকজন লোকের সামনে, কারামায়ের একজন বিচারক আমাকে নির্দোষ ঘোষণা করেছিলেন। আমি কেবল তাঁর কথা শুনেছিলাম। আমি বাক্যটি শুনেছিলাম যেন আমার সাথে কিছুই করার নেই। আমি সে সব সময়ের কথা ভাবছিলাম যখন আমি নির্দোষিতা দাবি করেছি, যে সমস্ত রাতে আমি এপাশ ওপাশ করে কাটিয়েছি এবং পালাতে চেয়েছি, আমি এতটা ক্রুদ্ধ ছিলাম কেউ বিশ্বাস করবে না। এবং আমি অন্যান্য সময়ে যখন আমার বিরুদ্ধে অভিযোগ করা জিনিসগুলো স্বীকার করেছিলাম, আমি যে সমস্ত মিথ্যে স্বীকারোক্তি দিয়েছিলাম সেগুলি নিয়ে আমি ভাবছিলাম। তারা আমাকে পুনঃশিক্ষার সাত বছরের কারাদÐ দিয়েছিল। তারা আমার দেহকে নির্যাতন করেছিল এবং আমার মনকে পাগলের পর্যায়ে নিয়ে গিয়েছিল। এবং এখন, আমার মামলাটি পর্যালোচনা করার পরে, একজন বিচারক সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন যে না, আসলে আমি নির্দোষ ছিলাম। আমি এ স্থান ত্যাগ করার জন্য স্বাধীন ছিলাম।
……………………………………
অনুবাদকঃ সোহানা আক্তার মনি
শিক্ষার্থী (মাস্টার্স), নৃবিজ্ঞান বিভাগ
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
মূল লেখা: