Print Friendly, PDF & Email

নৃবিজ্ঞানের প্রতিষ্ঠাতাদের মধ্যে অন্যতম হলেন এডওয়ার্ড টেইলর। তিনি ১৮৩২ সালে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি ছিলেন হ্যারিয়েট স্কিপার (Harriet Skipper) এবং জোসেফ টেইলর (Joseph Tylor) দম্পতির পঞ্চম সন্তান এবং তৃতীয় ছেলে।তারা সোসাইটি অফ ফ্রেন্ডস The Society of Friends (Quakers) এর সদস্য ছিলেন। উল্লেখ্য কোয়াকার একটা ধর্মীয় সংগঠনের নাম যারা “ইনার পিস” কে গুরুত্ব দেয়। টেইলরের অক্সফোর্ড কিংবা ক্যামব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তি হতে না‌পারার‌ পেছনে‌ এই ধর্মীয় বিশ্বাস প্রতিবন্ধকতা তৈরি করে। কেননা এ দুটো বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তি হতে হলে অ্যাংলিকান চার্চের ৩৯ টি আর্টিকেল সাথে একমত পোষণ করে সাইন করতে হতো। এজন্য টাইলর লন্ডনের টোটেনহ্যামে অবস্থিত কোয়াকারদের একটি বোর্ডিং স্কুলে শিক্ষা লাভ করেন। স্কুলটির‌নাম গ্রোভ হাউস (Grove House)। কিন্তু তার প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষাক্রম বেশী দূর আগায়নি। মাত্র ১৬ বছর বয়সে তার পিতার পিতলের ব্যবসা- কারখানার কাজে যুক্ত হন। 

টেইলর তার পারিবারিক ব্যবসায় মাত্র ৬ বছর কাজ করেন। ১৮৫৪ সালে তার যক্ষারোগ (টিউবারকিলোসিস) ধরা পরে। এবং এর থেকে পরিত্রাণ পেতে তিনি দক্ষিণ যুক্তরাষ্ট্রে যান। ১৮৫৭ সালে তার স্বাস্থ্যের কিছুটা উন্নতি হয়। এবং একটি ভ্রমণে হেনরি কৃষ্টির সাথে তার সাক্ষাৎ হয়। হেনরি কৃষ্টি ছিলেন কোয়াকার বিশ্বাসী একজন ধনবান ব্যক্তি এবং তিনি টায়লরের চেয়ে বিশ বছর বছরের বড় ছিলেন। প্রত্নতত্ত্ব, শিকার-সংগ্রাহী সমাজ এবং এথনোগ্রাফিক আর্টস সংগ্রহে কৃষ্টির আগ্রহ ছিল । মেক্সিকোতে একটি প্রত্নতাত্ত্বিক অভিযানে কৃষ্টি ছয় মাসের জন্য যুবক টেইলরকে তার সঙ্গী বানিয়ে ছিলেন। বলা হয়ে থাকে এই ছয় মাসের সফর টায়লরের পরবর্তী মৌলিক বই “আনা হুয়াক” (Anahuac) এর ভিত্তি তৈরি করে দেয়। এবং এটিকে তুলনা করা যায় চার্লস ডারউইনের Beagle Voyage-এর সঙ্গে; যেটা ডারউইনের পরবর্তী কর্মজীবনে ব্যাপক পরিবর্তন এনেছিল।

টেইলর ১৮৫৮  সালে ইংল্যান্ডে প্রত্যাবর্তন করেন বা ফিরে আসেন এবং আনা ফক্সকে বিয়ে করেন। ইংল্যান্ডে ফেরার পর তার বড় ভাই আলফ্রেড (যে কিনা ওই সময়ের মধ্যে নিজেকে একজন বিত্তশালী হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে পেরেছিল) তার গবেষণা কাজে দৃষ্টি স্থির করতে সাহায্য করেন এবং তাকে সহায়তা করেন। বিশেষ করে টাইলারের মানব সমাজের উন্নতি বিকাশ এবং সভ্যতার বিকাশের আগ্রহে তার অবদান রয়েছে। আর এই বিষয়টির প্রভাব আমরা দেখতে পাই ১৮৬৫ সালে প্রকাশিত বই Researches into the Early History of Mankind and Fevelopment of Civilization শিরোনামের বইতে।

Edward Burnett Tylor

টেইলরের জ্ঞান-চিন্তাভাবনাগুলো সবার কাছে সমাদৃত হয় ১৮৭১ সালে  প্রকাশিত Primitive Culture বইয়ের মাধ্যমে। এই বইতে প্রথমেই টেইলর সংস্কৃতির সংজ্ঞা প্রদান করেন। বইটির প্রথম পৃষ্ঠায়ই তিনি বলেন, “Culture or Civilization, taken in its wide ethnographic sense, is that complex whole which includes knowledge, belief, art, morals, law, custom, and any other capabilities and habits acquired by man as a member of society.” – E.B. Tylor

“সংস্কৃতি মানুষের সে সামগ্রিক অবস্থাকে বুঝায় যা জ্ঞান বিশ্বাস শিল্প নীতি আইন আচারপ্রথা এবং অন্যান্য অর্জিত গুণাবলিকে অন্তর্ভুক্ত করে একজন মানুষ সমাজের সদস্য হয়ে অর্জন করে থাকে।”(রহমান: ১৯৯২)।

টেইলরের সংস্কৃতির সংজ্ঞাটি এখন পর্যন্ত ব্যাপকভাবে সমাদৃত; বিশেষ করে নৃবিজ্ঞানে সংস্কৃতি সম্পর্কে আলোচনায়। তবে স্টকিং জুনিয়র (১৯৬৮) এর মতে, ক্রিয়াবাদী সমন্বয়, সাংস্কৃতিক আপেক্ষিকতা, অর্থপূর্ণ ইতিহাস এবং আচরণের নিয়ন্ত্রণবাদের মতো আধুনিক অনেকগুলো উপাদান এ সংঙ্গায় অনুপস্থিত।

১৮৭১ সালে তিনি রয়েল সোসাইটির (Royal Society) একজন ফেলো নির্বাচিত হন। অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটি হাজার ১৮৭৫ সালে তাকে সম্মানসূচক ডক্টরেট ডিগ্রি প্রদান করে এবং ১৮৮৩ সালে তাকে অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের জাদুঘরের কিপার (সংরক্ষক) হিসেবে নিয়োগ প্রদান করে। ১৮৮৪ সালে নৃবিজ্ঞানের একজন লিডার হিসেবে তিনি  নিয়োগ পান। এবং তিনি প্রথম ব্যক্তি যিনি অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃবিজ্ঞানের একজন অধ্যাপক হিসেবে পদমর্যাদা লাভ করেন। ১৮৯৬ সালে টাইলর এই সম্মানসূচক পদ লাভ করেন। 

টেইলর ১৯০৯ সালে শিক্ষকতা পেশা থেকে অবসরে যান। ১৯১২ সালে তিনি নাইট উপাধি পান লাভ করেন। বয়স বৃদ্ধির সাথে সাথে তার বিভিন্ন ধরনের জটিলতা তৈরি হয় তার মানসিক অবস্থার অবনতি ঘটে। ১৯১৭ সালে তিনি মৃত্যুবরণ করেন। তার স্ত্রী মারা যাওয়ার পর প্রায় ৬০ বছর তিনি একাকী জীবন যাপন করেন এবং তাঁর কোন সন্তান ছিল না।

ধর্মের উৎপত্তি সম্পর্কে টেইলরের বক্তব্য

টেইলর তার প্রিমিটিভ কালচার গ্রন্থে কেবলমাত্র ধর্ম ও সংস্কৃতির বিবর্তনবাদী ব্যাখ্যাকে প্রাধান্য দেন। তিনি ধর্মের বিকাশে প্রধানত তিনটি স্তরকে চিহ্নিত করেন; প্রথমত সর্বপ্রাণবাদ  বা Animism, দ্বিতীয়টি প্রকৃতি পূজা বা Nature worship এবং তৃতীয় পর্যায়ে বহুঈশ্বরবাদ এবং সর্বশেষে একেশ্বরবাদ বা Monothesm ধারায় ধর্মের বিবর্তনমূলক বক্তব্য প্রদান করেন। 

কী কারণে এবং কোন প্রকাশভঙ্গিতে ধর্মের উৎপত্তি ঘটে- এ প্রশ্নের উত্তরে টেইলর যুক্তি প্রদান করেন যে, আদিম মানুষ নিত্যদিনের অভিজ্ঞতার নিরিখে কোন ঘটনাকে বুঝার অক্ষমতা থেকে ধর্মীয় বিশ্বাস ব্যবস্থার উন্মেষ ঘটে।  

টেইলর ব্যাখ্যা প্রদান করেন যে, আদিম মানুষ উপলব্ধি করে দেহ-আত্মার দুটি সত্তা একসাথে যুক্ত থাকে এর একটি সত্তা দিবসে এবং অন্যটি রাত্রিতে ক্রিয়ারত থাকে। যখন কোন ব্যক্তির আত্মার দ্বৈত সত্ত্বা একযোগে দেহ ত্যাগ করে তখন ওই ব্যক্তির  জীবনাবসান ঘটে। অর্থাৎ আত্ত্বার সত্তা থেকে আত্মপূজার সৃষ্টি। ধর্মের আদিরূপ ছিল আত্মা সংক্রান্ত মানুষের ভাবনার মিশ্রিত আচারের সমষ্টি (Animism)।

ধর্মের ব্যাখ্যা প্রদানের ক্ষেত্রে তিনি নৃতত্ত্বের হলিস্টিক এ্যাপ্রোচ ব্যবহার করেন। তিনি এমনভাবে ধর্মের ব্যাখ্যা প্রদান করেছেন যেটার মধ্যে সকল রুপই অন্তর্ভুক্ত হয়, যেমন ‘The belief in Spritual Beings’ (আধ্যাত্মিকতায় বিশ্বাস)।

টাইলর আত্মার বিকাশের ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে বলেন নাটক,মোহ, কল্পনা, রোগ, জাগরণ ও ঘুম, জীবন-মৃত্যু ইত্যাদি প্রপঞ্চের পর্যবেক্ষণের ভ্রান্ত ধারণা থেকে। তিনি বলেন, মানুষ কেবল রক্তমাংসের শরীর নয় তাদের রয়েছে প্রাণ ও প্রাণবায়ু। প্রাণ আছে বলেই শরীর ভাবতে পারে, নড়তে পারে, কাজ করতে পারে। আর আদিম মানুষ দুটোকে অভিন্ন হিসেবে বিবেচনা করতে শুরু করে এবং আত্নার ধারণা লাভ করে। মৃত্যুর পর আত্মা স্থায়ীভাবে শরীর ত্যাগ করে এবং মাঝে মধ্যে স্বপ্নে হাজির হয়। ফলে এই বিশ্বাস জন্মলাভ করে যে, মানুষের মৃত্যুর পর আত্মা টিকে থাকে। তাই আদিম মানুষ বিশ্বাস করতে শুরু করেছিল যে, সব জিনিসেরই জীবন ও আত্মা আছে এবং ধর্মের এই আদি পর্যায় টেইলর Animism বলে আখ্যায়িত করেছেন।টেলরে উল্লেখ করেন আদিম মানুষ স্বীকার করেছে যে, আত্মা শরীরের চেয়ে শ্রেষ্ঠতর ছিল। তারা নিজেদের পরিবার ও জাতিকে সংরক্ষন করে এবং তাদের নৈতিক আচরণ পর্যবেক্ষণ করে। এই ধারণা তাদেরকে আত্মার সাথে যোগাযোগের প্রার্থনা এবং কার্যকর পূজার দিকে ধাবিত করে। Soul এবং Spirite অন্যত্র কোথাও বসবাস করে এই ধারণা থেকে পরকালের বিশ্বাস জন্ম হয়।

কালক্রমে Spirit কে দেবতার পদমর্যাদায় উন্নীত করা হয়েছিল এবং প্রতিটি দেবতা প্রকৃতি বা জীবনের একটি বিশেষ দিক নিয়ন্ত্রণ করে যা চূড়ান্তভাবে বহুইশ্বরবাদের বিকাশের পথে ধাবিত হয়। সকল দেবতা সমান গুরুত্বপূর্ণ ছিল না, ফলে দেবতাদের একটি ক্রমোচ্চতা  সৃষ্টি হয় এবং কালক্রমে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র ঈশ্বর ও দেবতারা পশ্চাতে চলে যায়, যা অবশেষে একত্ববাদ এর জন্ম দেয়।

টেইলরের ধর্মের বিশ্লেষণে পদ্ধতিগত শক্তি ও দুর্বলতা দুটোই দেখা দেয়। একদিকে তিনি পর্যাপ্ত পরিমাণে এথনোগ্রাফীক উপাত্ত সংগ্রহ করেন। চমৎকার উদাহরণ যোগে প্রতিটি বিষয়ে বিস্তারিত ব্যাখ্যা দেন। অন্যদিকে তার কিছু হীন এথনোগ্রাফীক কর্ম ছিল। কারণ তিনি নিজে এসব তথ্য সংগ্রহ করেননি। কিন্তু পর্যটক ও মিশনারীদের প্রতিবেদন এর উপর নির্ভর করেছেন, যারা পৃথিবীর বিভিন্ন অংশে পরিদর্শন করেছেন এবং এর ফলে দুর্বল তথ্য সংগৃহীত হয়েছে। আরো অভিযোগ করা হয় যে, টেইলর সামগ্রিকভাবে ধর্মীয় ব্যবস্থা নিয়ে আলোচনা করেননি বটে তবে অতিপ্রাকৃত শক্তি, আত্মা, পরকাল এবং ধর্মীয় অনুশীলনের বিশ্বাস, উৎপত্তি ও বিকাশের পুনর্গঠন করেছেন। তার কাছে ধর্ম ছিল মূলত মানুষের অভিজ্ঞতার ঘটনা উপলব্ধির প্রয়াস এবং আদিম দার্শনিকগণও বাস্তবিকভাবে মানুষের অভিজ্ঞতা বিশ্লেষণ করেছেন। এভাবে আমরা টেইলরের ধর্মের আলোচনায় দেখতে পাই যে, ধর্মের সামাজিক মাত্রা অনালোচিত ও অব্যাখ্যত রয়েছে।

তাঁর কিছু গ্রন্থ

Anahuac: or, Mexico and the Mexicans, Ancient and Modern (1861)

Researches into the Early History of Mankind and the Development of Civilization (1865) 

Primitive Culture (1871)

Remarks on Japanese Mythology (1877)

Review of The Principles of Sociology (1877)

Remarks on the Geographical Distribution of Games  (1880)

On the Origin of the Plough, and Wheel-Carriage (1881)

Anthropology an introduction to the study of man and civilization (1881)

Notes on the Asiatic Relations of Polynesian Culture (1882)

Old Scandinavian Civilisation Among the Modern Esquimaux (1884)

Notes on the Modern Survival of Ancient Amulets Against the Evil Eye (1890)

The Matriarchal Family System (1896)

Remarks on Totemism, with Especial Reference to Some Modern Theories Respecting It (1899)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here