ফেসবুক দক্ষিণ ও দক্ষিণপূর্ব এশিয়ার বাজার দখলে নিতে উঠেপড়ে লেগেছে কিন্তু এই প্লাটফর্মে নাগরিক অধিকার সম্পর্কিত বিষয়গুলো দেখতে একটি শক্তিশালী অভ্যন্তরিণ কাঠামো গঠন করার ব্যাপারে বরাবরই অনীহা দেখিয়ে আসছে।
ইংরেজিভাষী নয় এমন কোন দেশের একটা সোশ্যাল মিডিয়া কোম্পানির কথা কল্পনা করুন যেটা যুক্তরাষ্ট্রে এর ব্যবহারকারীর সংখ্যা বাড়াতে আগ্রাসীভাবে চেষ্টাতদবির চালিয়ে যাচ্ছে। ধীরে ধীরে এটা কেবল যুক্তরাষ্ট্রে খবরের প্রাথমিক উৎসেই পরিণত হয়নি, বরং এটা খোদ ইন্টারনেটেই পরিণত হয়েছে। কিন্তু আপনি দেখতে থাকলেন প্লাটফর্মটিতে হেইট স্পিচ, সহিংস কন্টেন্টগুলা ঘুরে বেড়ালেও এগুলোর ব্যাপারে রিপোর্ট করার প্রক্রিয়াটি সম্পূর্ণ অকার্যকর থেকে যাচ্ছে। কারণ কোম্পানিটি পর্যাপ্তসংখ্যক ইংরেজি জানা কন্টেন্ট মডারেটর নিয়োগ দেয়নি। এই সোশ্যাল মিডিয়া প্ল্যাটফর্মটি একটি গণহত্যায় নির্ধারক ভূমিকা পালন করে, যাতে লক্ষ লক্ষ মার্কিন নাগরিককে দেশ থেকে বিতাড়িত করা হয়েছে।
বা অন্য একটি পরিস্থিতি কল্পনা করুন: যুক্তরাষ্ট্রে সংখ্যালঘুদের টার্গেট করে ভয়ংকর এক দাঙ্গা সংগঠিত হয়েছে যাতে কয়েক ডজন লোককে হত্যা করা হয়েছে এবং দেশময় আতংক ছড়িয়ে পড়েছে। অথবা আপনি দেখছেন সংখ্যালঘুদের টার্গেট করে ধারাবাহিক গণপিটুনির ঘটনা ঘটছে। আপনার কাছে মনে হলো তৎপরবর্তী তদন্তগুলো কেবল মিথ্যা ভান, কারণ কোম্পানিটির কোন কর্মচারীকে এর জন্য কোনধরণের জবাবদিহিতার আওতায় আনা হয়নি।
উপরন্তু আপনি দেখলেন কোম্পানিটির শীর্ষ কর্তারা এবং সরকার একে-অপরের যোগসাজশে কাজ করছে এবং একে-অপরকে জবাবদিহিতা থেকে বাঁচাচ্ছে।
দক্ষিণ এবং দক্ষিণপূর্ব এশিয়ায় ফেসবুকের ব্যাপারে এটিই বাস্তবতা। ফেসবুক এ অঞ্চলটিকে কেবল একটা বাজার হিসেবেই দেখে – সমাজ, সম্প্রদায় বা বাড়ি হিসেবে নয়।
জাতিসংঘের মতে, ফেসবুক মিয়ানমারের গণহত্যায় “নির্ধারক ভূমিকা” পালন করেছিল যার ফলে ৮,০০,০০০ এরও বেশি রোহিঙ্গা মুসলমান বিতাড়িত হয়েছিল এবং দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় বিশাল মানবিক সংকট দেখা দিয়েছে। গণহত্যায় জড়িত মিয়ানমারের কর্মকর্তাদের তথ্য দেওয়ার জন্য জাতিসংঘের অনুরোধের জবাবে ফেসবুক –যা তার ব্যবহারকারীদের ডেটা মাইনিং করে বিশ্বের অন্যতম দামি সংস্থায় পরিণত হয়েছে– বলেছে যে “এটা তাদের উপর অযৌক্তিক হস্তক্ষেপ বা তাদের উপর বোঝা চাপানোর মত ব্যাপার”।
ফেসবুকের অপরাধের সহযোগী হওয়ার একই ধরনের দৃষ্টান্ত অন্য আরও কয়েকটি ধারাবাহিক ঘটনায় দেখতে পাওয়া যায়ঃ ২০১৮ সালে শ্রীলঙ্কার মুসলিম বিরোধী দাঙ্গা, ২০১২ এবং সম্প্রতি ২০২০ সালে ইন্ডিয়ায় মুসলিম বিরোধী দাঙ্গা ইত্যাদি। সম্প্রতি ওয়াল স্ট্রিট জার্নালের এক অনুসন্ধানী প্রতিবেদনে প্রকাশ হয়েছে ইন্ডিয়ায় বিজেপিকে ঘাটাতে চায় না বলে ফেসবুক তার হেইট স্পিচ নীতিমালা প্রতিপালন এড়িয়ে গেছে এবং ইসলামবিদ্বেষী বক্তব্য ফেসবুকে থাকতে দিয়েছে। সংক্ষেপে, ফেসবুক নীরব থাকার মাধ্যমে অপরাধের সঙ্গী হয়েছে এবং সহিংস নৃতাত্ত্বিক-জাতিবাদী শক্তির প্রতি পূর্ণ সম্মান বজায় রেখে চলেছে।
মূল বিষয় হচ্ছে ফেসবুক সামাজিক দায়বদ্ধতা এড়িয়ে বাজার খুঁজে চলেছে। ফেসবুক এবং এটার মেসেজিং প্লাটফর্ম হোয়াটসএপের সবচেয়ে বেশি ব্যবহারকারী রয়েছে ইন্ডিয়ায় (৩২৮ এবং ৪০০ মিলিয়ন যথাক্রমে) এবং দক্ষিণ এশিয়া হচ্ছে ফেসবুকের অন্যতম একটি বড় বাজার। ফেসবুক গ্লোবাল সাউথে ”ফ্রী বেসিকস” এর মত স্কিমগুলোর মাধ্যমে ইন্টারনেট হয়ে ওঠার জন্য কঠোর সংগ্রাম করেছে। যার মাধ্যমে সীমিত সংখ্যক ওয়েবসাইটে ফ্রী এক্সেস দেয়া হয়েছে। এগুলো ফেসবুকের একচেটিয়া ব্যবসাকে আরও শক্তিশালী করে তুলেছে।
ইন্ডিয়ার মত দুর্বল কিন্তু কাঁটাযুক্ত নিয়ন্ত্রক ব্যবস্থার দেশগুলোতে ব্যবসা পরিচালনা করার জন্য ফেসবুক প্রভাবশালী রাজনৈতিক ও কর্পোরেট পক্ষগুলোর সাথে ঘনিষ্ঠভাবে কাজ করছে। যেমন ইন্ডিয়ায় নরেন্দ্র মোদি ও তার পার্টি বিজেপি এবং সবচেয়ে ধনাঢ্য ব্যক্তি মুকেশ আম্বানি। লাভ বাড়ানোর জন্য ফেসবুক চাচ্ছে চায়নিজ উইচ্যাটের মত –যেটাতে রয়েছে ব্যাংকিং, গেমিং, ফুড ডেলিভারি, সামাজিক মাধ্যম, রাইড শেয়ারিং ইত্যাদি– ফেসবুক মালিকানাধীন সবগুলো প্লাটফর্মকে (ফেসবুক, ইনস্টাগ্রাম, হোয়াটসঅ্যাপ) একটা “এভরিথিং অ্যাপ” এর আওতায় একীভূত করে ফেলতে। এ প্রক্রিয়ার অংশ হিসেবে ফেসবুক ইন্ডিয়ায় হোয়াটসঅ্যাপে পেমেন্ট সিস্টেম যুক্ত করেছে।
ফেসবুক যেভাবে দক্ষিণ ও দক্ষিণপূর্ব এশিয়ায় বাজার দখল করছে সেভাবে এটি কি একটা কম্যুনিটি তৈরি করতে আগ্রহী? নাগরিক অধিকার সম্পর্কিত বিষয়গুলো দেখভালের জন্য ফেসবুক কি একটা শক্তিশালী আভ্যন্তরিণ অবকাঠামো গড়ে তুলতে যত্নবান? আমেরিকার প্রেক্ষাপটে, সাম্প্রতিক এক নাগরিক অধিকার সম্পর্কিত অডিট অনুসারে উত্তরটি হচ্ছে ‘না’। তাহলে দক্ষিণ ও দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ায় পরিস্থিতি আরও খারাপ হওয়াটাই প্রত্যাশিত। ইকুয়ালিটি ল্যাবের এক সমীক্ষা অনুসারে ফেসবুকে হেইট স্পিচ বল্গাহীনভাবে ছড়িয়ে পড়ছে এবং রিপোর্ট করার পরও সেগুলো থেকে যাচ্ছে।
সরকারি কর্মকর্তারা, বেসরকারি সংস্থাগুলো, একটিভিস্ট এবং অন্যরা ফেসবুককে ঘৃণাপূর্ণ মন্তব্যগুলো সরানোর ব্যবস্থা করার জন্য বারবার অনুরোধ করার পরও ফেসবুক দক্ষিণ ও দক্ষিণপূর্ব এশিয়ার ভাষায় দক্ষ কন্টেন্ট মডারেটর নিয়োগ দেয়ার ব্যাপারে আগ্রহ দেখায়নি যতটা তারা অন্য সেবাগুলো সরবরাহ করার ব্যাপারে আগ্রহী।
ফেসবুক কনটেন্ট মডারেশনের জন্য মূলত ঠিকাদারদের নির্ভরশীল। যার অর্থ হল ঠিকাদাররা ইচ্ছামত কন্টেন্ট মডারেটর ভাড়া করতে পারে এবং ফেসবুকও কোন ধরনের জবাবদিহিতা থেকে মুক্ত থাকতে পারে। এই ঠিকাদারদের মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র অথবা অন্য কোথাও হয়ত অফিস রয়েছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে একজন ফেসবুক কর্মচারী বছরে প্রায় ২৪০,০০০ ডলার উপার্জন করেন, যেখানে দক্ষিণ এশিয়ায় কনটেন্ট মডারেটরদের দিনে ৬ ডলার হিসাবে বেতন দেওয়া হয়। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে কন্টেন্ট মডারেশন সাইটগুলি মডারেটরদের অস্বাভাবিক কম বেতন, যৌন হয়রানি, শারীরিক লাঞ্ছনা, এবং মারাত্মক ট্রমার অভিযোগে পরিপূর্ণ। তাহলে দক্ষিণ ও দক্ষিণপূর্ব এশিয়ার সাইটগুলোর কী অবস্থা তা সহজেই অনুমেয়। আরও খারাপ বিষয় হচ্ছে, কন্টেন্ট মডারেশনের ফোকাস ও প্রাধান্য ইংরেজির মত ভাষাগুলোতেই থাকে। এর মানে হচ্ছে গ্লোবাল সাউথের শ্রমশক্তি শোষণ করে গ্লোবাল নর্থকে সেবা দেয়া হয় আর গ্লোবাল সাউথের বিশাল ভাষাগতগোষ্ঠীগুলোর জন্য রাখা হয়েছে খুবই অল্পসংখ্যক কন্টেন্ট মডারেটর।
কম্যুনিটির প্রতি ফেসবুকের অবজ্ঞার বিষয়টি একেবারে ফেসবুকের ডিজাইনেই স্পষ্টঃ ইকুয়ালিটি ল্যাবস’র স্টাডি দেখায় যে ফেসবুক এখনও কিছু বৃহত্তর ভাষায় তাদের কন্টেন্ট রিপোর্টিং গাইডলাইনগুলো অনুবাদ করেনি। একইভাবে যখন হেইট স্পিচ রিপোর্ট করার প্রসঙ্গ আসে দেখা যায় ফেসবুক তার জন্য যথাযথ অপশন ও শ্রেণীবিভাজন রাখেনি যা নিপীড়ন ও বৈষম্যকে স্থানীয় প্রেক্ষিতে প্রতিফলিত করে। উদাহরণ হিসেবে বর্ণপ্রথার (কাস্ট সিস্টেম ) কথা বলা যায়।
এই ব্যাপারে যথেষ্ট প্রমাণ আছে যে বাক স্বাধীনতা নিয়ে ফেসবুকের ওকালতি একটা ভান ছাড়া আর কিছুই না। যখন কাশ্মীরের প্রসঙ্গ আসে –পৃথিবীর সবচেয়ে বেশি সেনা অধ্যুষিত অঞ্চল, যার উপর ইন্ডিয়া-পাকিস্তান উভয়েই এখতিয়ার দাবি করে– ফেসবুক ইন্ডিয়ান আর্মির দ্বারা সংগঠিত মানবাধিকার লংঘনের বিষয়গুলো ও কাশ্মীরিদের আত্মনিয়ন্ত্রণ অধিকারের কথা পদ্ধতিগতভাবে সেন্সর করে। “ফ্রী কাশ্মীর” স্লোগানটি ফেসবুক সেন্সর করে রেখেছে।
ইন্ডিয়ার একজন ডিজিটাল এক্টিভিস্ট গত তিনবছরে যেসব আইডি ফেসবুক বন্ধ করে দিয়েছে সেগুলো নথিভূক্ত করেন। আশ্চর্যজনকভাবে এগুলা ছিল মোদি ও বিজেপির ব্যাপারে সমালোচনামুখর। বিপরীতে উগ্র ডানপন্থী কন্টেন্টগুলোর ক্ষেত্রে- কোন কন্টেন্ট যদি সরিয়ে নেয়া হয়ও তথাপি কন্টেন্ট পোস্ট করা আইডিটি বন্ধ করা হয়না।
এই গোটা ইস্যুতে ইন্ডিয়া সংক্রান্ত বিষয়গুলা ঘনিষ্ঠভাবে পর্যবেক্ষণ করা দরকার। এটা শুধু এই কারণে না যে এটা ফেসবুকের সবচেয়ে বড় বাজার, বরং এই কারণেও য, ইন্ডিয়ার আঁখি দাস ও শিবনাথ ঠাকরালের মত শীর্ষ কর্তারাই দক্ষিণ ও দক্ষিণপূর্ব এশিয়ায় ফেসবুকের কার্যক্রম পরিচালনা করে। মানবাধিকারের প্রতি যে ধরণের অবজ্ঞা, বিশেষ করে ইসলামবিদ্বেষে ফেসবুক-ইন্ডিয়া যেভাবে ডুবে আছে তার ভয়ংকর প্রভাব আরও বিস্তৃত অঞ্চলকেও প্রভাবিত করেছেঃ ইন্ডিয়ায় পলায়নরত রোহিঙ্গা মোসলমানদের বিরুদ্ধে হেইট স্পিচ ছড়াতে ফেসবুক -ইন্ডিয়া অনুমোদন দিয়েছে, যেটা মিয়ানমারেও হেইট স্পিচ ছড়ানোর অনুমোদন করে।
হিন্দুত্ববাদীদের সাথে ফেসবুক-ইন্ডিয়ার খাতির নিয়ে ওয়াল স্ট্রিট জার্নাল প্রতিবেদন প্রকাশ করার পর অক্টোবরের শেষের দিকে ফেসবুক-ইন্ডিয়ার পাবলিক পলিসি ডিরেক্টরের পদ থেকে আঁখি দাস পদত্যাগ করেন। ফেসবুক ইন্ডিয়ার ব্যবস্থাপনা পরিচালক “বিশাল অবদানের” জন্য আঁখি দাসকে ধন্যবাদ জানান এবং তার উজ্জ্বল ভবিষ্যত কামনা করেন। আঁখির জায়গায় যে শিবনাথ ঠাকরালকে আনা হয়েছে তার সাথেও রয়েছে বিজেপির ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক।
আঁখি দাসের পদত্যাগের ঘোষণা এমন এক সময়ে এসেছে যখন ফেসবুককে “মুসলিম বিদ্বেষী বিশ্ব ইঞ্জিন” আখ্যা দিয়ে অন্য আরেকটি গবেষণা প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে। তার পদত্যাগ ফেসবুকের ভেতরকার কাঠামোগত সমস্যা মোকাবেলায় কোন কাজেই আসবেনা।
যেটা প্রয়োজন সেটা হচ্ছে ফেসবুকের দক্ষিণ ও দক্ষিণপূর্ব এশিয়ায় মানবাধিকার সংশ্লিষ্ট বিষয়গুলো নিরীক্ষা করা এবং ফেসবুকের কর্মকর্তাদের সরাসরি জবাবদিহিতার আওতায় নিয়ে আসা। ইতিমধ্যেই অনেক জীবন নষ্ট হয়ে গেছে এবং আরও অনেকের জীবন বিপদাপন্ন।
………………………………
লেখকঃ আমান অভিষেক
আল-জাজিরা থেকে হাসান আল মাহমুদের অনুবাদ।