Print Friendly, PDF & Email

 

[অত্র লেখাটি AnthroBD’র পাঠকদের জন্য ভাষান্তর করেছেন জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃবিজ্ঞান বিভাগের প্রাক্তন শিক্ষার্থী আরজু মান্দ বানু (নিশি), মূল লেখক Yuan Chen and Ruth Mace]

বিশ্বের বেশিরভাগ মানুষই শারীরিক পরিশ্রমে প্রতিদিন প্রচুর সময় এবং শক্তি ব্যয় করেন। কিন্তু পরিবারে পুরুষ কিংবা নারী কে [বেশি] কঠোর পরিশ্রম করছে, তা কোন বিষয়গুলো নির্ধারণ করে? যেমন, বেশিরভাগ শিকারী-সংগ্রাহক সমাজে, পুরুষরা শিকারী এবং মহিলারা সংগ্রহকারী হওয়ায় পুরুষরা‌ সবচেয়ে দূরে হাঁটার মাধ্যমে [নারীর তুলনায়] বেশি পরিশ্রম করছে বলে আপাতদৃষ্টিতে মনে করা হয়। কিন্তু অন্যান্য সমাজে শ্রম বিভাজন কেমন?

আমরা গ্রামীণ চীনের তিব্বত সীমান্ত দূরবর্তী অঞ্চলের (বিশাল সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্য সম্পন্ন এলাকা) কৃষিকাজ এবং পশুপালন গোষ্ঠীর উপর একটি গবেষণা করে তুলে ধরেছি যে,একটি গৃহস্থালীতে বা পরিবারে সবচেয়ে বেশি কে কাজ করে এবং কেন করে তা আসলে কোন বিষয়গুলো দ্বারা নির্ধারিত হয়। আমাদের গবেষণালব্ধ ফলাফলগুলি কারেন্ট বায়োলজিতে (current biology) প্রকাশিত হয়েছে যা বিভিন্ন সমাজের কর্মক্ষেত্রে লিঙ্গীয় বিভাজনের উপর আলোকপাত করে।

বিশ্বজুড়ে প্রাপ্তবয়স্কদের অধিকাংশই বিবাহিত। বিবাহ একটি নিয়মে আবদ্ধ তাই স্বামী-স্ত্রী উভয় পক্ষ বিবাহ থেকে মোটামুটি সমান খরচ এবং সুবিধা আশা করতে পারে।কিন্তু একটি পরিবারে অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে স্বামী বা স্ত্রীর যদি অসম ক্ষমতা থাকে যেমন (স্বামী বা স্ত্রী বিবাহবিচ্ছেদের হুমকি দিচ্ছে) তবে স্বামী-স্ত্রীর উভয়ের অংশীদারিত্ব অসম অবদানের দিকে ধাবিত হতে পারে।

বাড়ি ত্যাগঃ বিষমকামী বিবাহ (হেটেরসেক্সুয়াল ম্যারেজ)পরবর্তী স্ত্রী বা স্বামী তার নিজ এলাকা ত্যাগ করে স্ত্রী বা স্বামীর পরিবারে বাস করার ফলে তাকে নির্দিষ্ট কাজের পরিমাণের চেয়ে বেশি কাজ করতে হয়।এই পূর্বানুমানটি আমরা অনুসন্ধান করার সিদ্ধান্ত নিয়েছি। এই ধরনের বিবাহে,গৃহস্থালীতে আসা নতুন ব্যক্তি সাধারণত পরিবারের সদস্যদের সাথে পরিচিত থাকে না এবং নতুন পরিবারের কারও সাথে তার অনুভূতি ভাগ করে নিতে পারে না।কাছাকাছি রক্ত সম্পর্কীয় আত্মীয় না থাকায় অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে তারা অসুবিধার সম্মুখীন হতে পারে।

বিশ্বজুড়ে বিবাহের সবচেয়ে সাধারণ ধরন হল যেখানে নারীরা “ছত্রভঙ্গকারী” হয়, তাদের নিজ বাড়ি ছেড়ে যায়, যখন পুরুষরা তাদের নিজ এলাকায় পরিবারের সাথে থাকে। এটি পিতৃতান্ত্রিকতা (patrilocality) হিসাবে পরিচিত।

নিওলোক্যালিটি (neolocality) যেখানে স্বামী-স্ত্রী উভয়ই বিবাহের পর ছত্রভঙ্গকারী হয় এবং তারা উভয়ই পরিবার থেকে দূরে একটি নতুন জায়গায় বাস করে-বিশ্বের অনেক জায়গায় এটি আরেকটি সাধারণ রীতি হিসেবে প্রচলিত।ম্যাট্রিলোকালিটি (matrilocality) যেখানে নারীরা তাদের পরিবারের সাথে থাকে এবং পুরুষরা তাদের স্ত্রীর পরিবারের সাথে বসবাস করতে। এটি বেশ দূর্লভ। এবংডুয়োলোকালিটি (duolocality) যেখানে স্বামী-স্ত্রী কেউই তাদের নিজ বাড়ি ছেড়ে যায় না এবং তারা আলাদা থাকে খুবই কম এটি দেখা যায়।

সৌভাগ্যবশত, সাংস্কৃতিক বৈচিত্র‍্যতা সম্পন্ন তিব্বতীয় সীমান্তের বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠীর মধ্যে উপরোক্ত চারটি ভিন্ন ভিন্ন ছত্রভঙ্গের নির্দশন পাওয়া যায়।

আমাদের গবেষণা দূরবর্তী গ্রামের ছয়টি ভিন্ন জাতিগত গোষ্ঠীর উপর দৃষ্টি নিবদ্ধ করে।চীনের লানঝো বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আগত আমাদের সহযোগীদের সাথে, আমরা 500 জনেরও বেশি লোকের সাক্ষাৎকার নিয়েছি। বিয়ের পরে তাদের ছত্রভঙ্গের অবস্থা সম্পর্কে জানার পাশাপাশি তাদের কাজের চাপ মূল্যায়ন করার জন্য তাদের একটি অ্যাক্টিভিটি ট্র্যাকার (ফিটবিটের মতো) পরার জন্য আমন্ত্রণ জানিয়েছি।

নারীদের কঠোর পরিশ্রমঃ আমাদের প্রথম অনুসন্ধান ছিল যে নারীরা পুরুষদের তুলনায় অনেক বেশি পরিশ্রম করেছে এবং এই শ্রমের বেশিরভাগ উপার্জন তাদের পরিবারে অবদান রেখেছে।তাদের কাজের পরিমাণের নিজস্ব প্রতিবেদন এবং তাদের অ্যাক্টিভিটি ট্র্যাকার দ্বারা এটি প্রমাণিত হয়েছিল।

নারীরা প্রতিদিন গড়ে 12,000 কদম হাঁটেন, যেখানে পুরুষরা 9,000 কদম হাঁটেন। তাই পুরুষরাও কঠোর পরিশ্রম করেছেন, তবে নারীদের তুলনায় কম।তারা অবসরে বা সামাজিক কর্মকাণ্ডে বা উদ্দেশ্যহীনভাবে ঘুরে বেড়াতে এবং বিশ্রামে বেশি সময় কাটিয়েছে।

এটি আংশিকভাবে সত্য হতে পারে।কারণ,নারীরা গড়পড়তা পুরুষদের তুলনায় শারীরিকভাবে দুর্বল এবং এর ফলে দর কষাকষির ক্ষমতা ও কমে যেতে পারে। কিন্তু আমরা এও দেখেছি যে, ব্যক্তি(পুরুষ হোক বা নারী) যারা বিবাহের পরে তাদের আত্মীয়দের থেকে দূরে থাকে তাদের কাজের চাপ যারা নিজ পরিবারের সাথে থাকে তাদের তুলনায় বেশি।

সুতরাং আপনি যদি নারী হন এবং বিবাহের পর নিজ বাড়ি থেকে দূরে চলে যান (যা সারা বিশ্বের বেশিরভাগ নারীরা করেন), আপনি কেবল আপনার নিজের পরিবারকে হারানোর ক্ষেত্রেই নয়, কাজের চাপের ক্ষেত্রেও কষ্টে ভোগেন। যখন নারী- পুরুষ উভয়ই ছত্রভঙ্গ হয়ে পড়ে এবং কেউ তাদের নিজ পরিবারের সাথে থাকে না, তখন উভয়ই কঠোর পরিশ্রম করে (যেহেতু আত্মীয়দের কাছ থেকে সামান্য সাহায্যই পাওয়া যায়) কিন্তু নারীরা এখনও কঠোর পরিশ্রম করে। আমাদের গবেষণা অনুসারে, কাজের চাপে নিখুঁত লিঙ্গীয় সমতা শুধুমাত্র এমন পরিস্থিতিতে ঘটে যেখানে পুরুষরা ছড়িয়ে পড়ে কিন্তু নারীরা তা করেন না।

এই গবেষণালব্ধ ফলাফলগুলি আমাদের বুঝতে সাহায্য করে যে কেন নারীরা বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে পড়ে, কিন্তু পুরুষরা সাধারণত তা করে না। ছত্রভঙ্গ বিশেষত পুরুষদের জন্য নেতিবাচক ফলাফল বয়ে আনে – তাদের পদসংখ্যায় হাটার মাধ্যমে প্রতিদিন প্রায় ২০০০টি পদসংখ্যা যোগ করতে হয় কিন্তু নারীদের জন্য প্রতিদিন প্রায় ১০০০টি পদসংখ্যা যোগ করতে হয়।

কৃষিকাজ, পশুপালন এবং বাড়ির কাজে ব্যয় করা সময় এবং শক্তি অবসরে ব্যয় করা সময়ের সাথে পাল্লা দেয়।তাই এই গ্রামীণ এলাকায় পরিবারগুলিতে দেখা যায় যে, অধিক শ্রম প্রদানের ফলে বিশ্রামে কম সময় ব্যয় করতে পারে। একটি বিবর্তনীয় দৃষ্টিভঙ্গি থেকে বলা যায় যে, বিশ্রাম ত্যাগ করা অনুকূল নয় যদি না এটি ফিটনেস (fitness) যেমন সন্তানদের আয়ু বৃদ্ধির ক্ষেত্রে অবদান রাখে।

এটি গবেষিতদের ক্ষেত্রে অনুকূল কিনা তা জানা যায় নি। কারণ, এটি নিয়ে খুব বেশি গবেষণা করা হয়নি। কিন্তু দরিদ্র এবং গ্রামীণ এলাকার ক্ষেত্রে এটি অনুকূল হতে পারে, কিন্তু ধনীদের ক্ষেত্রে অনুকূল হওয়ার সম্ভাবনা কম। বেশিরভাগ শহুরে এলাকায়, একটি নিষ্ক্রিয় জীবনধারা ব্যাপকভাবে প্রচলিত হয়ে উঠছে। গবেষণায় দেখা গেছে যে, হোয়াইট- কলার (white collar) কর্মীদের মধ্যে এই ধরনের জীবনধারা একটি গুরুত্বপূর্ণ জনস্বাস্থ্য সমস্যায় পরিণত হয়ে উঠছে। এগুলি অনেক দীর্ঘস্থায়ী শারীরিক সমস্যা-যেমন স্থূলতা, বন্ধ্যাত্ব এছাড়া বেশ কয়েকটি মানষিক ব্যাধির ও কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। ঘরে এবং বাইরে উভয় স্থানের কাজের ক্ষেত্রে লিঙ্গ বৈষম্য রয়েছে।

এক্ষেত্রে গবেষণাটি একটি বিবর্তনীয় দৃষ্টিভঙ্গি প্রদান করেছে যে পুরুষদের তুলনায় নারীদের কাজের চাপ নেওয়ার সম্ভাবনা বেশি। কিন্তু ধীরে ধীরে এই ধারণার পরিবর্তন হচ্ছে। যেহেতু নারীরা তাদের সঙ্গীর এবং তাদের নিজের পরিবার থেকে দূরে থাকা শুরু করেছে ফলে তাদের দর কষাকষির ক্ষমতা বৃদ্ধি পাচ্ছে। এতে তাদের স্ব-উৎপাদিত সম্পদ বৃদ্ধি পাচ্ছে এবং তারা আরো বেশি শিক্ষিত ও ব্যক্তিস্বাধীন হচ্ছে। অবশেষে, এই পরিবর্তনগুলি পুরুষদের শহুরে, শিল্প বা শিল্পোত্তর সমাজের কাজের দিকে পরিচালিত করছে।

[লেখার সকল দায়বদ্ধতা লেখক নিজে সংরক্ষণ করবেন।]

 

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here