নৃবিজ্ঞানের বিস্তৃত ক্ষেত্র হচ্ছে মানুষ। এটি মানুষ সম্পর্কিত সব কিছু নিয়ে আলোচনা করে তার স্বতন্ত্র নিয়মে যা নৃবিজ্ঞানকে সমাজবিজ্ঞান, মনোবিজ্ঞান, ইতিহাস এবং কলা ও বিজ্ঞান বিভাগের অন্যান্য শাখা থেকে পৃথক করে তোলে। আক্ষরিক অর্থে নৃবিজ্ঞান মানে মানুষ বিষয়ক বিজ্ঞান। কিন্তু শারীরবৃত্ত বিশেষজ্ঞ, ইতিহাসবিদ, মনোবিজ্ঞানী সহ আরো অসংখ্য ডিসিপ্লিন মানুষ বিষয়ক জ্ঞান চর্চা করে। তাহলে প্রশ্ন আসে নৃবিজ্ঞান কিভাবে অন্যান্য ডিসিপ্লিন থেকে আলাদা এবং কি কি ভিন্নতার কারণে নৃবিজ্ঞানীরা স্বতন্ত্রভাবে “আমরা মানুষ নিয়ে পড়ালেখা করি” বলার অধিকার অর্জন করেছে।
প্রাথমিকভাবে যা নৃবিজ্ঞানীদের অন্যান্য স্কলারদের থেকে সুস্পষ্টভাবে আলাদা করে তা হলো নৃবিজ্ঞানীদের কাজের অ্যাপ্রোচ। নৃবিজ্ঞানের সংজ্ঞায়নে তার স্বতন্ত্র পদ্ধতিগুলোকে কেন্দ্রবিন্দু ধরা হয়। তন্মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো এথনোগ্রাফি বা নৃকুলবিদ্যা, যা দ্বারা কোনো নির্দিষ্ট সম্প্রদায়ের সাথে সম্পুর্ণভাবে জড়িত হয়ে কাজ করাকে বোঝায়; অংশগ্রহণমূলক পর্যবেক্ষণ, যেখানে কোনো সম্প্রদায়ের কর্মকাণ্ডগুলো অংশগ্রহণ করার মাধ্যমে অনুধাবন করা হয়। এই ডিসিপ্লিনে মানুষের পূর্বপুরুষ ও তাদের ব্যবহার্য উপকরণ বিশেষভাবে গবেষণা করা হয়। এগুলো ছাড়াও মানুষের বর্তমান ও অতীতের বিভিন্ন দিক অধ্যয়ন করার জন্য নৃবিজ্ঞানীরা বিভিন্ন অ্যাপ্রোচ ব্যবহার করে থাকেন।
নৃবিজ্ঞানীদের মধ্যে কতক প্রত্নতাত্ত্বিকগণ অন্তর্ভুক্ত রয়েছেন যারা মানুষের রেখে যাওয়া বিভিন্ন উপকরণের চিহ্নের মাধ্যমে মানুষকে অধ্যায়ন করে। তারা শুধু অতীত বর্ণনা ই করে না বরং অতীতের জীবন পুনঃনির্মাণ করার চেষ্টা করে। ভাষাতাত্ত্বিক নৃবিজ্ঞানীরা মানুষের ভাষার ব্যবহারের ধরন থেকে মানুষকে অধ্যায়ন করে। তারা ভাষার ব্যাকরণ নয় বরং নির্দিষ্ট সম্প্রদায় কিভাবে একে অপরের সাথে যোগাযোগ করে এবং একটা ভাষা কিভাবে পৃথিবীতে তাদের অবস্থানকে আকৃতি দেয় তা নিয়ে গবেষণা করে। জৈবিক নৃবিজ্ঞানের নৃবিজ্ঞানীরা মানুষের বিবর্তনের সাধারণ নীতিগুলোকে সন্ধান করে না বরং তাদের আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দু হলো প্রাণী হিসেবে মানুষের বর্তমান যে প্রকৃতি সে অবস্থানে মানুষের পৌঁছানোর প্রক্রিয়া। তারা মানুষকে মানুষের সুদীর্ঘ ইতিহাস ও বিপুল শারীরিক বৈচিত্র্যতা থেকে অনুধাবন করে। এছাড়াও সমাজ-সাংস্কৃতিক নৃবিজ্ঞানীরা যেভাবে মানুষ চিন্তা করে এবং নিজের পরিবেশ ও অবস্থান থেকে যেসব জিনিস কে প্রাধান্য দেয় তা নিয়ে আলোচনা করে। বিপুল বৈচিত্রতার কারণে নৃবিজ্ঞানকে ঘিরে মাঝে মাঝে কিছু অস্পষ্টতা তৈরি হয়। যেমন কোনো প্রতিষ্ঠান বা দেশের নৃবিজ্ঞানী অন্যদেশ বা প্রতিষ্ঠানের সামাজিক বিজ্ঞানী বা ইতিহাসবিদ হিসেবে আখ্যায়িত হতে পারে।
মানুষ বিষয়ক অন্যান্য ডিসিপ্লিন এর সাথে নৃবিজ্ঞানের পার্থক্যের আরেকটি প্রধান জায়গা হল নৃবিজ্ঞান প্রসারতা নয় বরং গভীরতার দিকে মনোনিবেশ করে। একজন মনোবিজ্ঞানী হয়তো একশো জন মানুষকে নিয়ে একটা জরিপ করতে পারেন যেখান থেকে তিনি মানুষের চিন্তাধারা সম্পর্কিত জেনারাইজেবল বা সার্বজনীন কিছু জানতে চান। কিন্তু নৃবিজ্ঞানীরা সার্বজনীন বা সাধারণ চিন্তাধারা থেকে নির্দিষ্ট কোনো চিন্তাধারা জানতে বেশি আগ্রহী। তারা একই সময়ে অল্পকিছু কিন্তু মূল থেকে গভীরভাবে জানার প্রতি মনোনিবেশ করে। অন্যান্য সামাজিক বিজ্ঞানীদের মতনই নৃবিজ্ঞানীরাও প্রজাতি, জনসংখ্যা, সমাজ, অতীত ও বর্তমান নিয়ে তুলনামূলক আলোচনা করে। কিন্তু নৃবিজ্ঞানীরা প্রসঙ্গের ওপর বেশি গুরুত্ব আরোপ করেন- কে, কি, কোথায়, কখন ইত্যাদি প্রশ্নের উত্তর খোঁজার মাধ্যমে তাদের পর্যবেক্ষণকে আকৃতি দিয়ে থাকেন। নৃবিজ্ঞানীরা নির্দিষ্ট সম্প্রদায়কে নির্দিষ্ট সময়ে নির্দিষ্ট জায়গায় অধ্যয়ন করে এবং কিভাবে স্বতন্ত্রভাবে মানুষ নিজের পরিচয় লাভ করে তা নিয়ে আলোচনা করে।
বর্তমানে শুধু বহিরাগত স্থানেই না বরং প্রায় সর্বত্রই নৃবিজ্ঞানীরা কাজ করে এবং বিভিন্ন কর্মক্ষেত্রে রয়েছে নৃবিজ্ঞানীদের আনাগোনা। কর্পোরেশন, বিভিন্ন স্তরের সরকারি পদ, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও নন-প্রফিট অর্গানাইজেশনে নৃবিজ্ঞানীরা কাজ করে থাকে। বিশ্বব্যাপী নৃবিজ্ঞানের কর্মক্ষেত্র গুলোকে প্রধানত চার ভাগে ভাগ করে নৃবিজ্ঞানীরা তাদের কর্মজীবন নির্বাচন করতে পারে।
একাডেমিক ক্যারিয়ার:
বিদ্যায়তনে নৃবিজ্ঞান বিভাগ ও রিসার্চ ল্যাবরেটরিতে নৃবিজ্ঞানীরা কাজ করে ও গবেষণা শেখানো ও পরিচালনার কাজে নিযুক্ত থাকে। এছাড়াও ইউনিভার্সিটি প্রোগ্রামের অন্যান্য বিভাগ যেমন স্কুল অফ মেডিসিন, পাবলিক হেলথ, মহামারি বিদ্যা, ইথনিক স্টাডিস, কালচারাল স্টাডিজ, কমিউনিটি বা এরিয়া স্টাডিজ, ভাষাতত্ত্ব, এডুকেশন, বাস্তুশাস্ত্র, কগনিটিভ সাইকলজি ও স্নায়ুবিক বিজ্ঞানে নৃবিজ্ঞানীরা নিজেদের কর্মক্ষেত্র গড়ে তোলে।
কর্পোরেট ও বিজনেস ক্যারিয়ার:
কর্পোরেট টিমে নৃবিজ্ঞানীদের দৃষ্টিভঙ্গির উপযোগিতা উপলব্ধি করে বিভিন্ন কর্পোরেশন বিশদভাবে নৃবিজ্ঞানীদের খুঁজতে থাকে। মার্কেট রিসার্চে নিয়োজিত একজন কর্পোরেট নৃবিজ্ঞানী ভোক্তাদের প্রিফারেন্স প্যাটার্ন গবেষণা করে টার্গেটেড ফোকাসড গ্রুপ পরিচালনা করতে পারে যা পরিসংখ্যান বা সার্ভে মেথডে দৃশ্যমান থাকেনা। কিভাবে প্রোডাক্ট ও সার্ভিস এর মান উন্নয়ন করে ভোক্তাদের চাহিদা আরো ভালোভাবে মেটানো যায় তা জানার জন্য নৃবিজ্ঞানীরা ভোক্তা ও প্রযুক্তি ব্যাবহারকারীদের সাথে কথোপকথন করার সময় নিজেদের রিসার্চ স্কিল প্রয়োগ করে থাকে।
সরকারি পেশা:
পরিকল্পনা, গবেষণা ও ব্যবস্থাপনা সংক্রান্ত কাজের জন্য রাষ্ট্র ও স্থানীয় সরকার নৃবিজ্ঞানীদের সাহায্য নেয়। পুলিশ ডিপার্টমেন্ট রহস্যময় বিষয়াবলী খতিয়ে দেখার জন্য ফরেনসিক নৃবিজ্ঞানীদের সাথে কাজ করে এছাড়াও ফরেনসিক নৃবিজ্ঞানীরা বিশ্ববিদ্যালয় ও জাদুঘরেও নিযুক্ত থাকে। একাডেমিয়ার বাইরে নৃবিজ্ঞানীদের বৃহত্তম নিয়োগকর্তা হিসেবে যুক্তরাষ্ট্রীয় সরকার অন্যতম। সম্ভাব্য পেশার মধ্যে রয়েছে আন্তর্জাতিক উন্নয়ন, কালচারাল রিসোর্স ম্যানেজমেন্ট, আইনজীবী শাখা, রিসোর্স ম্যানেজমেন্ট, প্রতিরক্ষা ও নিরাপত্তা বিভাগ।
নন-প্রফিট ও সমাজ ভিত্তিক ক্যারিয়ার:
বেসরকারি সংস্থা গুলোর মধ্যে আন্তর্জাতিক স্বাস্থ্য সংস্থা ও উন্নয়ন ব্যাংক ব্যাপক বৈচিত্রতার কার্যক্রম পরিকল্পনা ও বাস্তবায়ন করার জন্য নৃবিজ্ঞানীদের নিযুক্ত করে। অনেক নৃবিজ্ঞানীরা নন-প্রফিট সংস্থার সাথে যুক্ত হয়ে স্থানীয় সম্প্রদায়ভিত্তিক কাজ করে। সম্প্রদায়ভিত্তিক গবেষণা সংস্থা, সমাজের প্রতিষ্ঠিত কোন সংস্থা, স্থানীয় বিদ্যালয় বা পরিবেশগত সংস্থার সাথেও নৃবিজ্ঞানীরা কাজ করে।
এই লেখাটি নিম্নোক্ত তিনটি আর্টিকেলের আলোকে সারসংক্ষেপ আকারে অনূদিত হয়েছে।
…………………………………..
অনুবাদকঃ ফারহানা ইসলাম
শিক্ষার্থী (অনার্স), নৃবিজ্ঞান বিভাগ
কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়