Print Friendly, PDF & Email

আমাদের দেশের বাস্তবতা থেকে পাবলিক-প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয় প্রসঙ্গে নানারকম বিতর্ক রয়েছে। কেননা এই দুটি ক্যাটাগরিকে অনেকে সময় এবং অর্থমূল্যে বিবেচনা করে। এগুলোর মানদন্ডের পাশাপাশি দুুটি ব্যবস্থার গুণগত মান নিয়ে আলোচনা করাটাই যৌক্তিক পয়েন্ট বলে আপাতত মনে করছি।

আমাদের দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো এখনো বিশ্বের দরবারে গুরুত্বপূর্ণ অবস্থান করে নিতে পারেনি। কেননা পড়ালেখার মান বিশ্বের উন্নত দেশগুলোর মানে এখনো পৌছাতে পারেনি। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে পাবলিক ও প্রাইভেট দুটি ক্যাটাগরির অধিনে উচ্চতর শিক্ষা গ্রহণের প্রচলন রয়েছে।

স্পেসিফিক ভাবে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়াশোনার মান বৃদ্ধি না হওয়ার পেছনে বহু কারণের মাঝে কয়েকটি কারণ হলো ছাত্র রাজনীতি, জনগনের ট্যাক্সের টাকার সাবসিডিতে পড়াশোনা, শিক্ষকগণ প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ে কোর্স নেওয়ার নামে অবাধ বিচরন ইত্যাদি।

অপরদিকে কিছু প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্তিৃপক্ষের ব্যবসায়িক মনোভাব শিক্ষার মান নিশ্চিত করার অন্যতম কারণ হয়ে হাজির হয়। আপাতত দৃষ্টিতে শিক্ষার মানের প্রশ্নে প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয় কোন ক্যাটাগরিতে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পিছিয়ে নেই।

কিছু দৃষ্টিভঙ্গি স্পষ্ঠ না থাকার কারণে আমাদের দেশের শিক্ষার্থীরা পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হতে না পারলে অনেক হতাশা ভোগে। তারা বুঝতে পারে না কোন জায়গায় পড়ালেখা করবে বা প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয় তার আকাঙ্খা পূরণ করতে পারবে কিনা ইত্যাদি।

শিক্ষার মানের কথা চিন্তা করে নিম্ন মধ্যবিত্ত বা মধ্যবিত্ত শ্রেণী ব্যতিত সকলের জন্য প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়কে আমি ব্যক্তিগতভাবে পরামর্শ দেই। এই ক্যাটাগরিতে খরচ অনেক বেশি হওয়ায় আর্থিকভাবে অস্বচ্ছলদের জন্য কঠিন। তবে মেধার ভিত্তি অগ্রগামীদের জন্য সকল প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়েই ওয়েভার নেওয়ার সুযোগ রয়েছে।

প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ে খরচ বেশি হওয়ার একটি কারণ হল- সরকারের পক্ষ থেকে কোন সাবসিডির ব্যবস্থা না থাকা। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে সরকারের লাখ টাকা খরচ হচ্ছে প্রতিবছর। জনগণের ট্যাক্সের টাকায় কেন এই সাবসিডি? এই প্রশ্নের উত্তরে আমরা জানতে পারি, এই গ্র্যাজুয়েটরা একদিন তাঁদের কর্মদক্ষতার বলে দেশের অর্থনীতিতে ভূমিকা রেখে সেই টাকা বহুগুণে ফিরিয়ে দেবেন। আসলে একটি দক্ষ জনশক্তিই রাষ্ট্রের মূল চালিকাশক্তি আর শিক্ষাই এর মূলমন্ত্র। আর প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়গুলো এ সেবাটিই করে যাচ্ছে একেবারে বিনা মূল্যে, রাষ্ট্রের কাছ থেকে এক পয়সাও না নিয়ে; বরং বিভিন্নভাবে রাষ্ট্রকে তারা ট্যাক্স দিচ্ছে। সেজন্য তাদের পক্ষে সকল শ্রেণীর শিক্ষার্থীর জন্য বিবেচনা করা কঠিন। খরচ বেশি হওয়ার কঠিন একটি বাস্তবতা রয়েছে। তাদের খোলা জায়গা নেই, বড় মাঠ নেই, পর্যাপ্ত রিসোর্স নেই। তারা ইচ্ছা করেই তা করছে না, বিষয়টি এরকম নয়! ঢাকা শহরের মাঝখানে এমনকি ছোট মাপের এক একরের একটি মাঠের ক্রয়মূল্য কত হতে পারে—কম করে হলেও এক শ কোটি টাকা। এক কলমের খোঁচায় একটি সরকারি বিশ্ববিদ্যালয় তা দখল করে নিতে পারে, কিন্তু প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে তা গড়ে তুলতে হয় তিলে তিলে।

আমরা উন্নত বিশ্বের দিকে তাকালে দেখতে পাই বিশ্বের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর শিক্ষার মানের র‌্যাংকিংয়ে প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়গুলো সবার শীর্ষে রয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের শীর্ষস্থানীয় ২০টি বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে কমপক্ষে ১৫টিই প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়। এই প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর ইতিহাস প্রায় কয়েক শ বছরের পুরোনো। যেমন: হার্ভার্ড প্রতিষ্ঠিত হয়েছে ১৬৩৬ সালে, ইয়েল ১৭০১ সালে, প্রিন্সটন ১৭৪৬ সালে কিংবা কলাম্বিয়া ১৭৫৪ সালে ইত্যাদি। আমাদের দেশেও এই পরিস্থিতি তৈরি হবে শুধু সময়ের ব্যবধান বাকি।

আজ থেকে প্রায় দেড় যুগ আগে পত্রিকায় অধ্যাপক জাফর ইকবালের একটি লেখা পড়েছিলাম, যার শিরোনাম ছিল এ রকম—দেশের সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো পরবর্তী আদমজী জুট মিল হচ্ছে কি না! অধ্যাপক জাফর ইকবাল যুক্তরাষ্ট্রে পড়াশোনা করেছেন এবং বাংলাদেশের সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকেও খুব কাছ থেকে পর্যবেক্ষণ করছেন। সেই প্রবন্ধে তিনি আফসোস করেছিলেন এই বলে যে তাঁর বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন মেধাবী শিক্ষক যুক্তরাষ্ট্র থেকে পিএইচডি শেষে তাঁর পূর্বতন স্থানে ফিরে না গিয়ে ঢাকার একটি নামী বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগদান করেছিলেন। এই মুহূর্তে সেই বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়টিতে একইভাবে আরও অন্তত চারজন আছেন, যাঁরা তাঁর সাবেক সহকর্মী! উচ্চশিক্ষা শেষে সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে তাঁরা ফিরে যাননি। এটাই বাস্তবতা যে, প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ে অধিকাংশ শিক্ষক উচ্চতর ডিগ্রি অর্জনকারী। যা প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের লেখাপড়ার মানকে বাড়িয়েছে। যেটা একটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য কঠিন। অপরদিকে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের যেই শিক্ষকেরা ডিগ্রি অর্জন করেছে তাদের উল্লেখযোগ্য একটি অংশ প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ে কোর্স পড়াচ্ছেন। আর্থিক সম্মানী ও পরিবেশের কারণে ভালো রেজাল্টধারী শিক্ষকগণ নিয়োজিত আছেন এসকল বিশ্ববিদ্যালয়ে। প্রকারন্তরে ক্ষতিগ্রস্থ্য হচ্ছে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা এবং বিশ্বের দরবারে কমছে তাদের পড়ালেখার মান।

আমি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের বিরোধী নই। আমি নিজেও বাংলাদেশের নামকরা পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়েছি। সেখানে আমি দেখেছি ছাত্র রাজনীতি, শিক্ষক রাজনীতি ইত্যাদি যা তাদের অবস্থানকে নিচে নামিয়ে দিয়েছে। তবে সরকারি-বেসরকারি উভয় ক্ষেত্রেই ভালো ও খারাপ মানের বিশ্ববিদ্যালয় আছে। আমাদেরকে সম্মিলিতভাবে এগুলোর মান নিশ্চিত করার জন্য কাজ করা উচিত। বাংলাদেশের প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয় গুলি অনেক ক্ষেত্রে সরকারী বিশ্ববিদ্যালয়ের চেয়ে ভালো করছে। আমরা দেখেছি, বেশ কয়েকটি প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয় কিউ.এস ওয়ার্ল্ড র‌্যাংকিং এ সরকারী বিশ্ববিদ্যালকে ছাড়িয়ে গেছে। যদিও সরকারী বিশ্ববিদ্যালয়ের মত বিশাল ক্যাম্পাস ও সরকারী সুযোগ নেই এগুলোর। সে সুযোগ পেলে হয়ত আরও ভালো করত।

বেসরকারী বিশ্ববিদ্যালয়ের সবচেয়ে বড় সুবিধা হল এখানে সেশন জট নেই। ফলে একটি ছাত্র তারাতারি লেখা পড়া শেষ করে চাকুরিতে বা কর্ম সংস্থানে ঢুকে পড়তে পারে। আর বিদেশে উচ্চশিক্ষার জন্য স্কলারশিপসহ নান সুবিধার ব্যবস্থাতো আছেই। অনেক বিশ্ববিদ্যালয় বিদেশী বড় বড় বিশ্ববিদ্যালয়ের সাথে চুক্তি করে রেখেছে। যাতে করে সংশ্লিষ্ঠ বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়া সহজ হয়। পৃথিবীর দিকে তাকালে দেখা যায় হার্ভাডসহ বিশ্ব সেরা বিশ্ববিদ্যালয় গুলোর অনেক গুলোই প্রাইভেট। পৃথিবীর সঙ্গে তালমিলিয়ে ভবিষ্যতে বাংলাদেশের প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয় গুলোও লেখা পড়ার মান ও গবেষণা ক্ষেতে এগিয়ে যাবে এ কথা বলা অবকাশ রাখেনা।

প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের পঠিত বিষয়সমূহের আরেকটি বড় সুযোগ হলো শিক্ষার মাধ্যম হিসাবে ইংরেজিকে বেছে নেয়া হয়েছে। শুধুমাত্র ইংরেজি ভাষায় লিখিত বই ও পরীক্ষার খাতায় নয়, বরং লেকচার প্রদান, আলোচনা, উপস্থাপনা, পরিবেশনাসহ সকল বিষয়ে ইংরেজি ও বাংলা উভয়েই ব্যবহার করা হয়। ফলে প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-ছাত্রীরা নিজেদেরকে গড়ে তুলতে পারে আন্তর্জাতিক মানের।

আমাদের দেশে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্যতম সমস্যা হলো সেশনজট, যা সাধারণত হয়ে থাকে রাজনৈতিক সংঘাত, স্বার্থসিদ্ধি এবং ক্লাস ও পরীক্ষার দীর্ঘসূত্রিতার জন্য। যার ফলে এদেশের ছাত্র-ছাত্রীদের অনেক মূল্যবান সময় নষ্ট হয়ে যায় জীবন থেকে। এসব কিছু মাথায় রেখে প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয় তাদের ক্যাম্পাসমূহকে করেছে রাজনীতি মুক্ত; সময়মত ক্লাস, পরীক্ষা ও রেজাল্ট প্রদানের জন্য এ সকল বিশ্ববিদ্যালয়ে সেশনজট কথাটি কল্পনা করতেও পারেনা। একজন ছাত্র বা ছাত্রী অতিসহজে নির্দ্বিধায় যথাসময়ে তার পড়াশুনা শেষ করতে পারে। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে সুবিধার কথা চিন্তা করলে শুধুমাত্র জনগনের ট্যাক্সের টাকায় কম খরচে পড়তে পারা যায়। এছাড়া আহামরি কিছু না। তাই কেউ পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি না হতে পারলে হতাশ হওয়ার কোন প্রয়োজন নেই। প্রাইভেট বিশ্ববদ্যালয়ে ভর্তি হতে পারলে ভালো। সেটা সম্ভব না হলে কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করা দরকার। পৃথিবীর কোন কাজই ছোট না, কাজকে সম্মান করে নেমে পড়তে হবে।

যেহেতু প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়সমূহ বাজার চাহিদার সাথে সংগতি রেখে বিভিন্ বিষয় খুলে থাকে, তাই এসকল বিষয়ে পড়াশুনা শেষে একজন ছাত্রছাত্রী দেশে বিদেশে প্রতিষ্ঠিত কোম্পানিতে সম্মানজনক চাকুরি পেয়ে থাকে। অনেক বিশ্ববিদ্যালয়ের সাথে নামকরা ব্যবসায়িরা সংযুক্ত থাকায় নিজেদের কোম্পানিতে লোক নিয়োগের ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-ছাত্রীদেরকে বিশেষ সুযোগ প্রদান করে থাকে। সেজন্য পাবলিক-প্রাইভেট ভেদাভেদ নয়, মানসম্মত শিক্ষা নিশ্চিত করা আমাদের প্রত্যয়।

প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্ষেত্রে প্রায়ই এ ধরণের অভিযোগ চালু ছিল যে মূলত অর্থ রোজগারের লক্ষ্যে কিছু প্রতিষ্ঠাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিচালনা করছে। তারা ছাত্র-ছাত্রী ভর্তি করে বেতনের টাকা সংগ্রহে লিপ্ত কিন্তু যোগ্য শিক্ষক সংগ্রহ করতেন না। শিক্ষার মান নয়, অর্থ রোজগারের বিষয়টি তাদের মূল আরাধ্য ছিল। তাই অনিবার্যভাবে ছাত্র-ছাত্রী, অভিভাবকবৃন্দ, সরকার এবং গোটা সমাজে উদ্বেগ ছড়িয়ে পড়ে। নিম্নমানের ও শিক্ষা কার্যক্রম বিবর্জিত নামসর্বস্ব বিশ্ববিদ্যালয়গুলি পরিচালনা বন্ধ করে একটি উপযুক্ত পরিবেশ সৃষ্টির জন্য সরকার ঘুরে দাঁড়াবার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। যার ফলশ্রুতিতে জাতীয় সংসদ ১৯৯২ সালের আইনটি বাতিল করে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় আইন, ২০১০ পাস করে। সুশাসন ও উন্নততর ব্যবস্থাপনায় নিশ্চিত করার জন্য নতুন আইনে ট্রাস্টি বোর্ড, সিন্ডিকেট, একাডেমিক কমিটি, কারিকুলাম কমিটি, অর্থ কমিটি, শিক্ষক নিয়োগ কমিটি ও সুশৃঙ্খল কমিটির মতো কয়েকটি সংবিধিবদ্ধ কমিটি গঠনের ও প্রতিশ্রুতি ভঙ্গের শাস্তির বিধান সংযোজন করা হয়। যার কারণে বর্তমানে বাংলাদেশের প্রত্যেকটি প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয় তাদের নিজস্ব ক্যাম্পাস তৈরি করছে এবং নতুন আঙ্গিকে শিক্ষার মান নিশ্চিত করে কাজ করে যাচ্ছে।

সুতরাং শিক্ষার্থীরা সকল ‍দু:শ্চিন্তা ছেড়ে পাবলিক-প্রাইভেট দ্বন্দ্বে না যেয়ে যার যেখানে স্কোপ রয়েছে সেখানে ভর্তি হওয়া উচিত। শিক্ষার মানের প্রশ্নে বাংলাদেশে পাবলিক বা প্রাইভেট প্রায় সবই কাছাকাছি বরং অনেক ক্ষেত্রে প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয় এগিয়ে।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here