Print Friendly, PDF & Email

ফেসবুকে প্রায়ই ‘ফেসবুক বুদ্ধিজীবি’ বলে একটা কথা বলতে দেখা যায় অনেককে। এটা সম্ভবত ফেসবুকে যারা বিভিন্ন বিষয়ে নিয়মিত লেখালেখি করেন, মতামত দেন তাদের উদ্দেশ্যে টিপ্পনী হিসেবে বলা হয়। তো ফেসবুক বুদ্ধিজীবি বলতে সম্ভবত এমন লোকদের বুঝানো হয় যাদের চিন্তা ও বসবাসের জগত কেবল ফেসবুকসহ অন্যান্য সোশ্যাল মিডিয়া ও ট্রাডিশনাল  মিডিয়ার সৃষ্টি করা বুদ্বুদে। অর্থাৎ ইনারা হচ্ছেন  সাইবারস্পেসের হাইপাররিয়াল জগতে বসবাস করা একদল সাইবর্গ (cyborg)।

সাইবারস্পেসের আবির্ভাব মাত্র সেদিন ঘটলেও সাইবর্গ টার্মটি ১৯৬০ সালের। নভোচারীদের জন্য  মহাকাশ অভিযানের দুইটা বড় সমস্যা হচ্ছে- বাড়তি অক্সিজেন নিতে হয় এবং তেজস্ক্রিয়তার মুখোমুখি হতে হয়। এ দুই সমস্যা থেকে পরিত্রাণের জন্য ১৯৬০ সালে বিজ্ঞানী ম্যানফ্রেড ক্লাইন্স এবং নাথান ক্লায়েন একটা থিওরি প্রস্তাব করেন। যাতে বাড়তি অক্সিজেনের বিকল্প হিসেবে একটা ইনভার্স ফুয়েল সেলের কথা বলা হয় যেটা রক্তের কার্বনডাইঅক্সাইড থেকে কার্বনকে পৃথক করে অক্সিজেনকে পুনরায় ব্যবহার করবে।

আর রেডিয়েশন থেকে বাঁচার জন্য তারা একটা সেন্সরযুক্ত সাইবর্গ এর প্রস্তাব করেন যেটা স্পেস স্টেশনে থাকার সময় স্বয়ংক্রিয়ভাবে নভোচারীদের শরীরে তেজস্ক্রিয়তার মাত্রা নির্ণয় করবে এবং সে অনুসারে নিজ থেকেই স্বয়ংক্রিয়ভাবে প্রয়োজনীয় পরিমাণে মেডিসিন ইনজেক্ট করবে।

এই থিওরি থেকেই সাইবর্গের অবতারণা। তারও আগে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পূর্বকালীন সায়েন্স ফিকশনগুলোতে মানুষ ও মেশিনের সংযোগের ধারণাটি জনপ্রিয়তা পায়।  ১৯৬৫ সালে ডি এস হ্যালেসি তার “সাইবর্গঃ ইভ্যুলেশন অব দ্য সুপারম্যান” লেখায় সাইবর্গ নিয়ে আলোচনা করেন।

হ্যালেসি সাইবর্গ এর এমন একটি  বৈশিষ্ট্যপূর্ণ ভূমিকার কথা বর্ণনা করেন যেটা মূলত স্তন্যপায়ী প্রাণীর মন তথা ব্রেইনের সাথে বহিঃস্থ বস্তুর সেতুবন্ধন হিসেবে কাজ করে। অর্থাৎ এটা অভ্যন্তরিন স্পেসের সাথে বহিঃস্থ স্পেসের সম্পর্কের ভূমিকা পালন করে। সহজভাবে বললে সাইবর্গ হচ্ছে জৈবিক সক্ষমতাকে বৃদ্ধি করার জন্য মানুষের শরীরের সাথে প্রযুক্তিকে যুক্ত করা। এটার একটা উদাহরণ হতে পারে কৃত্রিম পেসমেকার। যেটাকে হৃদযন্ত্রের সাথে যুক্ত করে হৃৎস্পন্দন ঠিক রাখা হয়।

এবার আসা যাক হাইপাররিয়ালিটি প্রসঙ্গে। হাইপাররিয়ালিটি হচ্ছে এমন অবস্থা যখন বাস্তব জগত ও কাল্পনিক জগতকে আলাদা করা যায় না। কাল্পনিক জগত বলতে বুঝানো হচ্ছে এমন জগত যা বাস্তব জগতসদৃশ কিন্তু আসলে বাস্তব নয় এবং এটাকে বাস্তব জগত হিসেবেই ভাবা হয়।

এমন অবস্থায় কল্পনা ও বাস্তবতা, মানুষের বাস্তব বুদ্ধিবৃত্তি ও যন্ত্রের কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা এবং ভার্চুয়াল রিয়ালিটি ও ফিজিক্যাল রিয়ালিটি মিলেমিশে একাকার হয়ে যায়। ফরাসি সমাজবিজ্ঞানী, দার্শনিক  জাঁ বদলিয়ার্ড ও ইতালিয়ান দার্শনিক, সাহিত্যিক উমবার্তো একোসহ অন্যান্য তাত্ত্বিকরা হাইপাররিয়ালিটি ধারণা সম্পর্কে বিস্তারিত বলেছেন।

বদলিয়ার্ড মনে করেন মার্ক্সের পন্য সম্পর্কিত যে ইউজ-ভ্যালুর ধারণা সেটা দিয়ে  হাইপাররিয়ালিটির বিষয়-আশয়গুলোকে বোঝা যায় না, বরং বুঝতে হবে সুইস ভাষাতাত্ত্বিক, দার্শনিক ফার্দিনান্দ দি সস্যুরের চিহ্ন ব্যবস্থার সাহায্যে। বদলিয়ার্ড মনে করেন এটা কেবল এর প্রতিনিধিত্বকারী প্রতিক গুলোর সাথে বাস্তবতাকে মিশিয়ে ফেলা বা দ্বিধা তৈরির মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকেনা বরং এমন কিছু প্রতীক ও সিগনিফায়ার তৈরি করে যেগুলো এমন কিছুকে রিপ্রেজেন্ট করে যার কোন বাস্তব অস্তিত্বই নেই।

প্রযুক্তির যত অগ্রগতি হচ্ছে এবং  সাইবারস্পেসগুলো যত  সম্প্রসারিত হচ্ছে  মানুষ তত ক্রমশ সাইবর্গ এ পরিণত হচ্ছে  এবং তারা বাস্তব জগত থেকে বিচ্যুত হয়ে হাইপাররিয়ালিটিতে আটকা পড়ছে। মোবাইল ফোন, ইন্টারনেট, ফেসবুকসহ অন্যান্য সোশ্যাল মিডিয়া মানুষের জন্য পেসমেকারের ভূমিকাই পালন করছে এখন।

সকালে ঘুম থেকে ওঠার পরই সাইবর্গরা যে কাজটা সর্বপ্রথম  করেন সেটা হলো মোবাইল ফোন হাতে নেয়া। তারপর ইন্টারনেটে ঢোকা, সোশ্যাল সাইটগুলোতে ঢোকা, ইনবক্স চেক করা, নতুন পোস্ট করা মাই ডে স্টোরিতে কত ভিউ হলো, কত রিঅ্যাক্ট, টাইমলাইনে পোস্ট করা স্ট্যাটাস বা ভিডিওতে কত লাইক-কমেন্ট-শেয়ার-ভিউ হলো এসব দেখা। তারপর প্রাত্যহিক অন্যান্য কাজ। দিনভর, রাতে  ঘুমানোর আগ মুহুর্ত পর্যন্ত, চক্রাকারে এটাই চলতে  থাকে। একটা পোস্টে অনেক লাইক-শেয়ার পাওয়া গেলে মন ভালো হয়ে যায়, না পেলে হতাশা কাজ করে।

অল্পকিছু মানুষ সোশ্যাল সাইটগুলোতে লাইক-শেয়ার-ভিউকে টাকায় পরিণত করতে পারলেও অধিকাংশ মানুষের ক্ষেত্রেই এসবের কোন ইউজভ্যালু নাই, সে উদ্দেশ্যও অধিকাংশ সাইবর্গে পরিণত হওয়া মানুষের থাকেনা। তথাপি এগুলো তাদের জীবনে ভ্যালু এড করে। বদলিয়ার্ড সস্যুরের বরাতে হাইপাররিয়ালিটির যে সাইন, সিম্বল, সিগনিফায়ারের কথা বলেন সম্ভবত সেগুলোই হলো সোশ্যাল সাইটের লাইক-শেয়ার-ভিউ।

মোবাইল ফোন, ইন্টারনেট, সোশ্যাল সাইটগুলোর ব্যবহার মস্তিষ্কে ডোপামিন ও অন্যান্য মন ভালোকারী হরমোনের বন্যা বইয়ে দেয়। হরমোন নিঃসরণের চক্র স্থির হয় এসব ডিভাইস ও সাইট ব্যবহারের চক্রের সাথে। ফলে  হঠাৎ করে মোবাইল ফোনসহ অন্যান্য ডিজিটাল ডিভাইস ও সোশ্যাল সাইট থেকে দূরে রাখা হলে একজন সাইবর্গ বিমর্ষ হয়ে পড়েন। কারণ এতে  ডোপামিন ক্ষরণে হঠাৎ হেরফের ঘটে। পেসমেকার সরিয়ে ফেললে একজন হৃদরোগী যেমন আর বেঁচে থাকতে পারেননা তেমনি একজন সাইবর্গকে হাইপাররিয়ালিটি থেকে সরিয়ে আনলে এর তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়া দেখা দেয়।

হাইপাররিয়ালিটিতে বসবাসকারী একজন সাইবর্গ যখন জীবন ও জগত সম্পর্কে নানা দৃষ্টিকোণ থেকে নানাবিধ বিশ্লেষণ হাজির করেন তার সেই বিশ্লেষণ কখনো বাস্তব জগতসম্মত হয় না। কারণ বাস্তব জগত থেকে ইতিমধ্যেই তিনি ছিটকে পড়েছেন। প্রচুর বই পড়ে বুদ্ধিজীবী, দার্শনিক হয়ে যাওয়া মানুষদের, যাদের বাস্তব জগতের সাথে কোন যোগসংযোগ নাই, আমি হাইপাররিয়ালিটিতে বসবাসকারী সাইবর্গই মনে করি। বই এক্ষেত্রে কেবল একটা প্রযুক্তি হিসেবে কাজ করে এবং এরা  বইয়ের নিচে চাপা পড়া হাইপাররিয়ালিটিতে আটকা পড়েন। ফলে এমন লোকদের ‘ফেসবুক বুদ্ধিজীবি’ বলে টিপ্পনী কাটা অন্যায্য কিছু না।

কিন্তু, যেকথা বলার জন্য এত কথার অবতারণা সেটা হলো ফেসবুকে নিজের চিন্তা ও বিশ্লেষণ প্রকাশ করেন এমন প্রত্যেকেই বাস্তবজগত থেকে বিচ্যুত নন। ফেসবুককে কেবল তারা চিন্তা প্রকাশের মাধ্যম মনে করেন। বাংলাদেশের ক্ষেত্রে যদি বলি- অনেক বুদ্ধিজীবী আছেন যারা আগে পত্রিকায় লেখালেখি করতেন, চাইলে এখনও করতে পারেন, কিন্তু তা না করে নিজের চিন্তা ও বিশ্লেষণ ফেসবুকে প্রকাশ করেন। কারণ যেভাবে লিখতে চান, যা লিখতে চান পত্রিকাগুলো সবসময়  সেগুলো প্রকাশ করার সাহস রাখেনা। লেখায় অযাচিত সম্পাদনা হস্তক্ষেপ, সেন্সর, পত্রিকার লেখা প্রকাশ করতে রাজি না হওয়া বহু চিন্তককে পত্রিকায় লেখা প্রকাশের প্রতি বিরুপ করে তুলেছে।

ফলে  তথাকথিত ব্লগ বুদ্ধি জীবি, ফেসবুক বুদ্ধি জীবির একটা বাস্তবতা থাকলেও ফেসবুকে চিন্তা প্রকাশ করেন এমন সকলকেই হরেদরে ফেসবুক বুদ্ধিজীবী বলে টিপ্পনী কাটলে হয়ত আপনি নিজেই নতুন কোন তাৎপর্যপূর্ণ চিন্তার সাথে পরিচিত হওয়া থেকে বঞ্চিত হবেন। তবে অবশ্যই হাইপার রিয়ালিটিতে বসবাসকারী বুদ্ধিজীবীদের প্রভাবে করাপ্ট হওয়া থেকে সাবধান থাকা জরুরি। কারণ এদের সংখ্যা অনেক অনেক।

লেখাটি লিখেছেন- হাসান আল মাহমুদ।

[লেখার সকল দায়বদ্ধতা লেখক নিজে সংরক্ষণ করবেন।]

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here