– লেখক হাসান আল মাহমুদ:
অনেকদিন ধরে ফেসবুকে কম সময় ব্যয় করার চেষ্টা করছি। কিন্তু ইদানীং ফেসবুকটা দুঃসহ হয়ে উঠেছে দুই কারণে। এক, ফেসবুকে ঢুকলে করোনা নিয়ে আতংকিত হয়ে যেতে হচ্ছে। দুই, এনিয়ে হিপোক্রিট ও কাপুরুষ মধ্যবিত্ত শিক্ষিতদের স্কেপগোটিং সাইকোলজি দেখে মনমেজাজ ঠান্ডা রাখা সহজ হয়না।
আতংকিত থাকা শারীরিক মানসিক উভয় দিক থেকে ক্ষতিকর। মানুষ যখন উদ্বিগ্ন হয় তখন এর রেসপন্সে ব্রেইন কিছু কেমিক্যালের (হরমোন) সিক্রেশন ঘটায়। এতে যেসব সিরিয়াস শারীরিক সমস্যার উদ্ভব ঘটে তা নিচের পোস্টার চার্টে দেখুন। কয়েকটা দেখুন করোনা সিম্পটমের সাথেও মিলে যায়। এগুলোর মধ্যে এসময়ে সবচে সমস্যাজনক হলো আতংকে ইম্যুিউন সিস্টেম দুর্বল হয়ে যাওয়া। করোনা মোকাবেলা করতে হলে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা শক্তিশালী রাখার কোন বিকল্প নাই। ফলে আতংকিত হওয়া কোন কাজের কাজ না।
অবশ্যই সচেতন থাকতে হবে। সচেতন থাকতেছি। হ্যান্ডশেক করিনা, হাত ধুইতেছি, বাড়িতেই থাকতেছি বেশিরভাগ সময়, তারপরও এদেশে যেকোনো ছিদ্রপথে করোনায় মৃত্যু চলে আসতে পারে। কেবল এদেশে না, যেকোন দেশেই তো মৃত্যুর এই নিয়ম। ফলে যদি অনিবার্য হয়, অত্যন্ত শান্ত সমাহিত চিত্তে মরে যাওয়ার আকাঙ্খা করি। পিলে চমকে, চোখ উল্টে ভয়ার্ত মৃত্যু নিশ্চয়ই ভাল অভিজ্ঞতা হবেনা। মৃত্যুর জন্য মানসিকভাবে তৈরী থাকাও এখন বুদ্ধিমানের কাজ হবে বলে মনে করি।
warning: বড় লেখা। আপনার সময় নষ্ট হতে পারে।
এবার আসি স্কেপগোটিং সাইকোলজি নিয়ে। রেনে জিরার্দ স্কেপগোটিং ম্যাকানিজম নিয়ে কথা বলেছেন তার দ্য স্কেপগোট বইতে। মানুষ কিভাবে সমাজে কোন উদ্ভূত সমস্যায় ব্যক্তিতে ব্যক্তিতে বা গ্রুপে গ্রুপে অনিবার্য হয়ে ওঠা সংঘর্ষ এড়ানোর জন্য অপর কোন ব্যক্তি, প্রাণী বা বস্তুর উপর সমস্ত দায়দায়িত্ব চাপিয়ে তাকে বলি দিয়ে দেয়, যে আসলে সমস্যার মূল কারণ নয়। এবং এভাবে শৃঙ্খলা-সংহতি ফিরিয়ে আনে সমাজে। স্কেপগোটিং সাইকোলজিটা হচ্ছে এরকম- মনের মধ্যে থাকা অস্বস্তিকর অনুভূতিগুলো যেমন, অপমান, ক্ষোভ, হতাশা, অপরাধবোধ, হিংসা দুর্বল কারো উপর ঝেড়ে দিয়ে হালকা হওয়া। যার কারণে এসব সমস্যা হইতেছে তাকে এড়ানোর জন্য, কারণ মুখোমুখি হইলে তার সাথে পারা যাবেনা।
‘It is beneficial for the society to place the entire blame on a single person, someone everybody could agree on: a scapegoat.’
-Peter Thiel
করোনা ইস্যুতে আমাদের মিডলক্লাস কিভাবে কাজটি করেছে তার কয়েকটি কেস স্টাডি করা যাক!
ডাক্তার-নার্সরা সেবা না দেয়ায় রোগীর মৃত্যু
বিভিন্ন জায়গায় করোনা সিম্পটম নিয়ে আসা রোগীদের ডাক্তার-নার্সরা সেবা দিচ্ছেনা। ফলশ্রুতিতে মৃত্যুর ঘটনা ঘটার কথাও জানা যাচ্ছে । এনিয়ে ডাক্তার-নার্সদের চৌদ্দগোষ্ঠী উদ্ধার করে অসভ্যতা করতেছেন মিডলক্লাস ছোটলোকরা।
করোনায় সবচে ঝুঁকিতে হেলথপ্রফেশনালরা। আমাদের মধ্যম আয়ের দেশ ও উন্নত বিশ্বের চেয়েও শক্তিশালী সরকারব্যবস্থা (এখানে একটু হাসুন, হা হা..) দীর্ঘদিন সময় পেয়েও ডাক্তার-নার্সদের আবশ্যকীয় নিরাপত্তার কোন ব্যবস্থা করেনি, রোগীর প্রকৃত সংখ্যা ফাঁস হয়ে যাবে বলে আইইডিসিআর ছাড়া কোথাও করোনা নির্ণয়ের অনুমতি দেয়নি। তাহলে কোন আক্কেলে কেউ মনে করতে পারে ডাক্তার-নার্সদের এভাবে আত্মহত্যা করতে রাজি হওয়া উচিত? আমাদের মিডলক্লাস যেন তাই আবদার করতেছে। তাকত থাকলে এরা এদের আব্বা সরকারের উদ্দেশ্যে কিছু ঝাঁঝালো কথা বলুক।
করোনার ভিতর নির্বাচন, সিএইসিকে গালাগাল
করোনা আউটব্রেকের মধ্যেই তিনটি আসনে উপনির্বাচন হয়ে গেল। শিক্ষিত মিডলক্লাস বেকুবেরা এনিয়ে এমন হাউকাউ শুরু করে দিল যেন নির্বাচন বলে কোন কিছু এখনও দেশে আছে। যেন এটা একটা সুশাসন ও গণতন্ত্রের দেশ যে হঠাৎ একটু বিচ্যুতি হচ্ছে বলে সুনাগরিকরা সমালোচনায় হৈ হৈ করে উঠলেন! এই বেকুবরা কি জানেনা করোনা না হলেও মানুষ ভোট দিতে যেতনা? এই বেকুবরা কী জানেনা নির্বাচন স্থগিত করার কিংবা সুষ্ঠু করার ক্ষমতা সিইসির বাপেরও নাই। এরা কি ভুলে গেছে এরকম ভোটধর্ষণের কনসেন্ট এরা বহু আগেই দিয়ে রেখেছে? ধর্ষণের অনুমতি যখন দেয়াই আছে তখন সেটা রাতে হবে নাকি দিনে হবে নাকি মহামারীর সময়ে হবে তা নিয়ে চিল্লাফাল্লা একটা বেহুদা ব্যাপার নয় কি?
আসলে মিডল ক্লাস শিক্ষিতরাই কি একেকটা সিইসি না? এরা তো চিল্লাফাল্লা করে বরং এধরণের ভোটধর্ষণকে প্রাসঙ্গিকতা দিচ্ছে। আর ভাবতেছে বিশাল বিপ্লব করে ফেলতেছি। এরা তো আসলে জানে ‘বিগ ব্রাদার’ যা চায় তাই হয়, সিইসি একটা নস্যি, একটা পুতুল। তবু এরা সিইসিকেই গালাগাল দিবে এদের কাপুরুষ স্কেপগোট সাইকোলজির কারণে। বিগ ব্রাদারকে কিছু বলার তাকত যেহেতু নাই, বললে যেহেতু চাকরি যাবে বা চাকরি হবেনা বা ডান্ডার বাড়ি পড়বে বা তুলে নিয়ে যাবে ইত্যাদি ইত্যাদি, ফলে এদের একটি বলির পাঁঠা সিইসিকে প্রয়োজন, পাঁঠাটিকে বলি দিয়ে বিগ ব্রাদারের সাথে আধ্যাত্মিক সম্পর্ক অটুট রাখার তরে।
মানিক মিয়া এভিনিউতে আতশবাজি, লক্ষ্মীপুরে খতমে শাফা
১৭ মার্চ শেখ মুজিবুর রহমানের ১০০ তম জন্মবার্ষিকী উপলক্ষে মানিকমিয়া এভিনিউতে জমকালো আতশবাজি ফোটানোর আয়োজন করা হয়। উপভোগ করতে এতে কয়েক হাজার লোকের সমাগম হয়। পরদিন লক্ষ্মীপুরে করোনা থেকে মুক্তির জন্য খতমে শাফা পড়তে কয়েক হাজার লোকের সমাগম হয়। ফেসবুকে খতমে শাফা নিয়ে মিডলক্লাস আচ্ছামত গালাগাল করলেন, বিবিসিও নিউজ করলো, কিন্তু মানিক মিয়া এভিনিউর আতশবাজি নিয়ে তেমন কথা বললেননা। এভাবে জড়ো হয়ে পার্থনা করা এখন বেকুবিপনা ছাড়া আর কিছু না, এটাকে জাস্টিফাই করার সুযোগ নাই। সরকার নিজেই যদি জনসমাগমের আয়োজন করে সাধারণ মানুষ সতর্ক হবে কিভাবে? কিন্তু মিডল ক্লাস ও তাদের রক্তের ভাই মিডিয়া কেন আতশবাজির আয়োজনকে সমালোচনার টার্গেট না বানিয়ে খতমে শাফাকে টার্গেট করলো? কারণ প্রথমোক্তটিতে অশান্তির সম্ভাবনা আছে, পাছার চামড়া নাও থাকতে পারে। দ্বিতীয় টার্গেটটি নিরাপদ ক্ষোভ ঝাড়তে। স্কেপগটিং সাইকোলজি।
মুফতি ইব্রাহিমকে নিয়ে ক্ষোভ
মুফতি ইব্রাহিম নামে একজন ইসলামী আইন বিশেষজ্ঞ আছেন, ধর্মের নামে আবোলতাবোল কথা বলায় যার কোন জুড়ি নাই। তার কথাবার্তা ট্রল হওয়ার মতই। কিন্তু শিক্ষিত মিডলক্লাস ফেসবুকে তাকে নিয়ে এমন ইতরামিতে মেতে উঠেছে যেন কেবল বাংলাদেশে নয়, সারা দুনিয়াতে করোনা এনেছে এই লোক। সমস্ত ক্ষোভ তার উপর। স্কেপগোটিং সাইকোলজি।
এটা এতদূর পর্যন্ত গড়িয়েছে যে, করোনা থেকে মুক্তির জন্য নির্দিষ্ট একটা দোয়া পড়তে বলতেছেন ইসলাম ধর্মীয় পন্ডিতরা –এটা নিয়েও তারা বিদ্বেষ দেখাচ্ছেন। কি অদ্ভূত কথা, মানুষ দোয়া করবেনা?! দোয়া কিভাবে বস্তুগতভাবেও ফাংশন করে সেব্যাপারে এই বেকুবদের কোন ধারণাই নাই।
লোকেরা আয় উন্নতি বাড়ার জন্য আল্লাহর কাছে দোয়া করে। কিন্তু তাদের এই বাস্তব বুঝও আছে যে কাজ না করে ঘরে বসে থাকলে আল্লাহ এসে খাবার দিয়ে যাবেনা। আপনি মাসে ৮০ হাজার টাকা আয় করেন, কিন্তু যা ভোগসুখ করেন তারপরও সবসমই অসাস্থ্য, বিষাদ, মানসিক এবং বাস্তবিক অভাব-পীড়নে বেঁচে থাকেন। আর আরেকজন ৮ হাজার টাকা আয় করেও সুসাস্থ্য, মনোতুষ্টি, উদ্যম সহকারে দুনিয়াতে বেঁচে আছেন। আপনি কিভাবে দাবি করতে পারেন এই লোকের উন্নতি আপনার চেয়ে বেশি নয়? আপনি ধরেন ৭০ বছরের দীর্ঘ জীবন পেলেন, কিন্তু গোটা জীবনটাই কেটেছে প্রশান্তিহীনতায়, অপমানে, দুনিয়াতে কোন কৃতিত্বের সাক্ষর রাখতে ব্যর্থ হয়ে। আরেকজন ধরেন, ৫৫ বছর বেঁচেছে নামকাম, শ্রদ্ধা, প্রশান্তি ও কৃতিত্ব সহকারে। আপনি কিভাবে দাবি করতে পারেন প্রকৃতার্থেই আপনি এ লোকের চেয়ে দীর্ঘজীবন পেয়েছেন?
কেউ যদি দোয় পড়ে নিরুদ্বেগ থাকতে পারে, ইচ্ছাশক্তি শক্তিশালী রাখতে পারে অসম্ভব নয় যে এই মেন্টাল তাকে করোনা প্রতিরোধের শক্তি জোগাবে।
এগুলো তো এমন আপেক্ষিক বিষয়। ধর্ম, দর্শন, মনস্তত্ব। আর বিজ্ঞান তো ক্রমশ পারফেক্ট হইতে চায় নিজেরে খারিজ করে করে। যেটা নিজেই একটা ধর্ম হিসেবে আবির্ভূত হওয়ার প্রবণতা দেখায়। ফলে বিজ্ঞান দিয়ে ধর্মের ভূমিকাকে দেখতে চাওয়া মূর্খতা নয়্?
শোষণ পীড়ন বঞ্চনা অপমান ইত্যাদিতে মিডলক্লাসের মনে যখন ক্ষোভ দানা বাঁধে, যখন রেজিমের সাথে সংঘর্ষ অনিবার্য হয়ে ওঠে তখন এরা মনের ঝাল মিঠাতে একজন পাঁঠাকে খোঁজে বলি দেওয়ার জন্য যাতে বিগ ব্রাদারের সাথে দ্বন্দ্বে যেতে না হয়। মিডলক্লাস এভাবেই জুলুমতন্ত্রকে টিকিয়ে রাখে, পরোক্ষে। বিগ ব্রাদারও একজনকে কোরবানি দিয়ে দেন। এমনই কোরবানির পশু সম্রাট, পাপিয়া প্রমুখ। মন্ত্রী উপদেষ্টারা থাকেন সবসময় সম্ভাব্য স্কেপগোট। যেকোনো গন্ডগোলে মিডলক্লাস ছোটলোকগুলা ও তাদের প্রতিনিধি রোমান্টিক বুদ্ধিজীবি, মিডিয়া আওয়াজ তুলে ‘বিগব্রাদারকে ভূল বুঝানো হইছে’, ‘সঠিক তথ্য দেয়া হয়নি, নইলে বিগব্রাদার তো এমনা করার কথা না।’ কী পুতু পুতু আদুরে যুক্তি, যেন বিগব্রাদার কিছুই জানেননা, বুঝেননা। তিনির একটা মোমের পুতুল।
বিগব্রাদারকে চিনতে কি সমস্যা হচ্ছে? এর বাংলা হচ্ছে “বড়ভাই” করলে কিন্তু হবে না। জর্জ অরওয়েল তার বই ‘১৯৮৪’ তে বিগ ব্রাদারের পরিচয় করেছেন এভাবে-
At the apex of the pyramid comes Big Brother. Big Brother is infallible and all-powerful. Every success, every achievement, every victory, every scientific discovery, all knowledge, all wisdom, all happiness, all virtue are held to issue directly from his leadership and inspiration.
এখন বিগ ব্রাদার বললে কল্পনায় যে আসে কখনও হতে পারে বিগ ব্রাদার সে নয়, বরং অদৃশ্য কোন শক্তি। যে অদৃশ্য শক্তি তার প্রয়োজনে এই বিগব্রাদারকেও স্কেপগোট বানাতে কসুর করবেনা।
যেমন জিরার্দ বলতেছেন,
“Before execution, scapegoats were often worshipped like deities…
These are the roots of monarchy: every king was a living god, and every god a murdered king. Perhaps every modern king is just a scapegoat who has managed to delay his own execution.”
ফলে এই করোনার দিনেও কিছুটা বাঁচতে চাইলে, কিছুটা চিকিৎসা পাইতে চাইলে, দুর্ভিক্ষে পাড়তে না চাইলে প্রকৃত সমস্যা এবং যথাযথ কারণ ধরে কথা বলুন মিডলক্লাস শিক্ষিত ছোটলোকেরা! বিগব্রাদারকেই প্রশ্ন করুন! নায়ককে রেখে সাইডনায়ককে নিয়ে টানাটানি নয়। এক একটি পুতুলকে স্কেপগোট বানিয়ে মনের জ্বালা সাময়িক মিটবে বটে, মুক্তি মিলবেনা।