বাংলাদেশে যদিও খুব সাম্প্রতিক সময়ে নৃবিজ্ঞানের প্রাতিষ্ঠানিক বিকাশ ঘটেছে, তবুও এই অঞ্চলে ভ্রমণকারী, মিশনারি এবং ঔপনিবেশিক শাসকগণ নৃবিজ্ঞানের শুরুর দিকের রচনাগুলির মাধ্যমে এর উপকরণগুলো উপস্থাপন করেছেন।
এই অঞ্চলের সাংস্কৃতিক বা সামাজিক ইতিহাসের নৃতাত্ত্বিক সারাংশ পাই এরিকসেন এবং নীলসনের রচনাগুলির (এরিকসেন ও নিলসন, ২০০১) মাধ্যমে যা প্রোটো-নৃতত্ত্ব বা স্নায়বিক সম্পর্কিত বিষয়গুলো সংজ্ঞায়িত করে। এদের মধ্যে নৃবৈজ্ঞানিক কাজের প্রাথমিক বর্ণনাগুলো পাওয়া যায় মিশনারি বর্ণনা এবং ঔপনিবেশিক প্রশাসনিক রেকর্ড হতে।
বাংলাদেশের নৃবিজ্ঞানের তিনটি উন্নয়নমূলক পর্যায়
১. নৃবিজ্ঞানের পূর্ববর্তী কাজ ও গঠনমূলক পর্যায়
২. নৃবিজ্ঞানের প্রতিষ্ঠা পর্ব (৭০ এবং ৮০ এর দশক)
৩. পৃথক বিভাগ হিসাবে নৃবিজ্ঞানের প্রতিষ্ঠা পর্ব
নৃবিজ্ঞানের পূর্ববর্তী কাজ ও গঠনমূলক পর্যায়
বাংলায় সামাজিক জীবন সম্পর্কে কিছু সাহিত্যসূত্র বাদে প্রাচীন এবং মধ্যযুগীয় সময়ে আমাদের জ্ঞানের উৎস ছিল খুবই সীমিত। কলনিয়াল পূর্ববর্তী সময়ের সামাজিক এবং সাংস্কৃতিক গঠন সম্পর্কিত বিবরণ মূলত এই অঞ্চলে ভ্রমণকারীদের এবং ধর্মপ্রচারকদের কাছ থেকে এসেছিল ।
বাংলাসহ ভারতীয় উপমহাদেশ সম্পর্কে কিছু উল্লেখযোগ্য লেখা পাওয়া যায়: বোচোন ও থোমাজ (১৯৮৮ এর মধ্যে আসল ১৫২১), ডু জারিক (১৬১৫), হুয়ান ও ছেং-চন (১৯৭০ আসল ১৫৪৪), লেজ (১৮৮৬), মানরিক (১৬৫৩ অনুবাদ লুয়ার্ড, ও হোস্টেন ১৯২৬ সালে), ফিলিপস (১৮৮৫), ভ্যান ডার হেইডেন (১৬৭৫) এবং জুয়ানজ্যাং (১৯৫৮ সালে বিলের মাধ্যমে অনূদিত)।
এই লেখাগুলির মাধ্যমে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে গ্রামের জীবন, বন্দোবস্তের ধরণ, ভূগোল, নেভিগেশন, ধর্ম, শিল্প ও বাণিজ্য, সংস্কৃতি, স্থানীয়প্রতিষ্ঠান, প্রশাসন, এবং অন্যান্য। এই উৎসগুলোর লেখক ছিল বেশিরভাগ বিদেশী-বংশোদ্ভূত ভ্রমণকারী, নাবিক, ব্যবসায়ী বা ধর্মপ্রচারক যারা অন্যান্য সংস্কৃতি বোঝার চেষ্টা করেছেন।
ঔপনিবেশিক আমলে, উল্লেখযোগ্য সংখ্যক অধ্যয়ন হয়েছে উপমহাদেশে বসবাসরত মানুষের জীবন পরিচালনা পদ্ধতি অনুসন্ধান করতে । এই অধ্যয়নগুলি ঔপনিবেশিক শাসক দ্বারা পরিচালিত হয়েছিল মূলত জনগনকে অধিনস্থ করে রাখা এবং প্রশাসনিকভাবে নিয়ন্ত্রণে রাখার জন্য। গবেষণাগুলি মূলত কিছু থিমকে ফোকাস করে। যেমনঃ ভাষা এবং বিভিন্ন গোষ্ঠীর ভাষাগত বৈশিষ্ট্য, বর্ণ ব্যবস্থা এবং সামাজিক স্তরবিন্যাস, স্থানীয় মানুষের বর্ণগত বৈশিষ্ট্য,বিভিন্ন জাতিগত বা স্থানিক গোষ্ঠীর সামাজিক বৈশিষ্ট্য ইত্যাদি। এই অঞ্চলে (বাংলাদেশ) নৃবিজ্ঞানেরজ্ঞানের আলাপ-আলোচনা শুরু হয়েছিল বিশেষত বিংশ শতাব্দীর মাঝামাঝি ঔপনিবেশিক পরবর্তী যুগে ।
একইভাবে বিভিন্ন দেশের খ্যাতনামা নৃবিজ্ঞানীরাও এদেশের পার্বত্য চট্টগ্রামের ক্ষুদ্রনৃগোষ্টীদের অনুসন্ধানে আগ্রহী হয়েছিলেন। প্রথম উদ্যোগটি ক্লড লেভি স্ট্রস থেকে এসেছিল, তিনি একজন খ্যাতিমান ফরাসি নৃবিজ্ঞানী। তিনি বাংলাদেশের পূর্বাঞ্চলে পার্বত্য চট্টগ্রাম বনভূমিগুলির নিয়মিত বন সম্পর্কিত কিছু ক্ষেত্র-ভিত্তিক গবেষণা পরিচালনা করেছিলেন । পার্বত্য অঞ্চলের লোকের উপর গবেষণা পরিচালনা করার মাঝে,১৯৫২ সালে, লেভি-স্ট্রাউস আদিবাসীদের সংস্কৃতি বৈচিত্র্যের সমৃদ্ধ সঞ্চয়দেখে অবাক হয়ে গেলেন এবং এই স¤প্রদায়গুলোর মধ্যে নৃবিজ্ঞানেরঅন্বেষণের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করলেন।
ফ্রান্সের একজন সমাজবিজ্ঞানী পাইরি বেসেগনেট (১৯৫৭) এবং আমেরিকার খ্যাতিমান দক্ষিণ এশীয় বিষয়ে অভিজ্ঞ এবং সংস্কৃতি ভূগোলবিদ ডেভিড সোফার (১৯৬৩,১৯৬৪) পার্বত্য চট্টগ্রামে আদিবাসীদের স¤প্রদায়গুলি নিয়ে বিভিন্ন গবেষণা চালিয়েছিলেন।
নৃবিজ্ঞানের প্রতিষ্ঠা পর্ব (৭০ এবং ৮০ এর দশক)
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সমাজবিজ্ঞান অনূষদ প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে বাংলাদেশে নৃবিজ্ঞানের প্রাতিষ্ঠানিক সূচনা হয়েছিল ১৯৫৭ সালে। প্রাথমিকভাবে এটি বাংলাদেশে নৃকুলবিদ্যা এবং নৃবিজ্ঞানেরপড়াশোনা সম্পর্কিত সংগঠন করার জন্য একটি ফোরাম হিসাবে কাজ করেছে।
বাংলাদেশে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগ ছাড়াও রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলাদেশ স্টাডিজ ইনস্টিটিউট (আইবিএস) নৃবিজ্ঞানের বিকাশে আরও একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল । ইনস্টিটিউটটি ১৯৭৪ সালে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল এবং তখন থেকে, এটি গ্রামীণ সমাজের বিভিন্ন বিষয়ে নৃবিজ্ঞানেরগবেষণা পরিচালনা করে আসছে।
দেশের সর্বাধিক মর্যাদাপূর্ণ প্রতিষ্ঠানগুলির মধ্যে স্নাতকোত্তর গবেষণা ইনস্টিটিউট হিসাবে আইবিএস অন্যতম হিসেবে বিবেচিত হয়েছে। এটি বহু বিদেশী নৃবিজ্ঞানীদের বাংলাদেশে কাজ করার জন্য আকৃষ্ট করেছিল।উদাহরণস্বরূপ, জিন এলিকসন (১৯৭৪), পিটার বার্টোকি (১৯৭৪-১৯৭৫), জোয়ানা কিরকপ্যাট্রিক (১৯৭৫-১৯৭৬), বাংলাদেশ-বংশোদ্ভূত আমেরিকান নৃবিজ্ঞানী, জোয়ানা কিরকপ্যাট্রিক (১৯৭৬), এছাড়াও ক্লারেন্স সি মলনি, একজন মার্কিন নৃবিজ্ঞানী এবং ভাষাবিদ যিনি ১৯৭৯ থেকে ১৯৮২ পর্যন্ত আইবিএসের সাথে কাজ করেছেন।
এভাবে ১৯৭০ এবং ১৯৮০ এর দশকের মাঝামাঝি সময়ে নৃবিজ্ঞানের বিকাশে বাংলাদেশ স্টাডিজ ইনস্টিটিউট একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে । এটা একটি উল্লেখযোগ্য বিষয় যে, আইবিএস এতে অধ্যয়ণরত এম. ফিল এবং পি. এইচডি শিক্ষার্থীদের একটি গুরুত্বপূর্ণ কোর্স হিসেবে নৃবিজ্ঞান প্রদান করছে।
এটি সম্ভবত স্নাতকোত্তর স্তরে দেশের একমাত্র ইনস্টিটিউট যা তার ছাত্রদের মধ্যে নৃবিজ্ঞানের প্রচার করে। এটা এমনকি ছাত্রদের আর্থিক সহায়তা প্রদান করে এবং বাংলাদেশের সমাজ ও সংস্কৃতি সম্পর্কিত নৃবিজ্ঞানেরগবেষণা চালানোর জন্য উপযুক্ত কর্ম পরিবেশ সৃষ্টি করে।
পৃথক বিভাগ হিসাবে নৃবিজ্ঞানের প্রতিষ্ঠা পর্ব
পৃথক বিভাগহিসাবে নৃবিজ্ঞান সর্বপ্রথম চালু হয়েছিল ১৯৮৫/৮৬ সালে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়। তারপর ৯০ এর দশকে এবং ২০০০ এর শুরুর দিকে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় নৃবিজ্ঞান প্রোগ্রাম শুরু করে (উভয়সম্মান এবং মাস্টার্স)। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় (১৯৯২), চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় (১৯৯৬), শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় (১৯৯৫), রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় (১৯৯৮/৯৯),কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয় (২০০৯) এবং জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় (২০০৮) এর অন্তর্ভুক্ত।
একই সময়ে বেশ কয়েকটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ও তাদের নৃবিজ্ঞান এবং সমাজবিজ্ঞান বা সামাজিক বিজ্ঞান প্রোগ্রামে নৃবিজ্ঞান কোর্স অন্তর্ভুক্ত করেছে। ইন্ডিপেন্ডেন্ট ইউনিভার্সিটি বাংলাদেশ, নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়, ইস্ট ওয়েস্ট বিশ্ববিদ্যালয়, ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়, গ্রিন বিশ্ববিদ্যালয়, এশিয়ান ইউনিভার্সিটি বাংলাদেশ, ঢাকা আন্তর্জাতিক ইউনিভার্সিটি, , এশিয়া প্যাসিফিক ইউনিভার্সিটি, আশা বিশ্ববিদ্যালয়, ইউনিভার্সিটি অব লিবারেল আর্টস বাংলাদেশ এবং আরও কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয় পৃথক বিভাগ হিসাবে বা অন্যান্য বিভাগের অনুমোদিত কোর্স হিসাবে নৃবিজ্ঞান সংযুক্ত করেছে।
বি: দ্র: এই লিখাটি Saifur Rashid and Hasan Shafie এর Situating Anthropology in Bangladesh: Transformations and Trajectories in the Anthropology Tradition অবলম্বনে সাজানো হয়েছে।