ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃবিজ্ঞান বিভাগের সম্মানিত অধ্যাপক রাশীদ মাহমুদ স্যার গতকাল ৩১ মার্চ ২০২১ রোজ বুধবার সন্ধ্যায় ব্রেইন স্ট্রোক করে মারা যান। সাতক্ষীরার শ্যামনগর উপজেলায় পিএইচডি’র মাঠকর্মে জন্য তিনি সেখানে অবস্থান করছিলেন। সন্ধ্যায় স্ট্রোক করলে স্যারকে তাৎক্ষণিক শ্যামনগর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নিয়ে যাওয়া হয়। কর্তব্যরত ডাক্তার তাকে মৃত ঘোষণা করেন।
শৈশব ও পারিবারিক জীবন:
অধ্যাপক রাশীদ মাহমুদ ১৬ আগস্ট ১৯৭৬ সালে ফেনী জেলার পাঁচগাছিয়া ইউনিয়নের ছৈয়দ আহমদ চেয়ারম্যান বাড়িতে জন্ম গ্রহণ করেন এবং সেখানেই তার শৈশব অতিবাহিত হয়। তিনি ২০০১ সালে লাইলা ফেরদৌস এর সাথে পারিবারিক জীবন শুরু করেন। মৃত্যুকালে তিনি স্ত্রী ও দুই সন্তান রেখে মারা যান।
শিক্ষা জীবন:
জনাব মাহমুদ ১৯৯২-৯৩ সেশনে ঢাকা রেসিডেনসিয়াল মডেল কলেজ থেকে এসএসসি পাস করেন। ১৯৯৪ সালে নটর ড্যাম কলেজ থেকে এইচএসসি পাস করেন। এরপর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃবিজ্ঞান বিভাগে ভর্তি হন এবং ১৯৯৭ সালে স্নাতক ও ১৯৯৮ সালে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জন করেন। পরবর্তীতে তিনি ২০০৮ সালে ইউনিভার্সিটি অফ নিউ সাউথ ওয়েলস (University of New South Wales) থেকে সমাজবিজ্ঞান ও নৃবিজ্ঞানে আরেকটি মাস্টার্স সম্পন্ন করেন।
কর্মজীবন:
১০ মার্চ ২০০০ সালে ইডেন মহিলা বিশ্ববিদ্যালয় কলেজের সমাজবিজ্ঞান বিভাগে খন্ডকালীন শিক্ষক হিসেবে যোগদানের মাধ্যমে তাঁর কর্মজীবন শুরু করেন। ১০ নভেম্বর ২০০০ পর্যন্ত এখানেই শিক্ষকতা করেন। ৩রা জানুয়ারি ২০০১ সালে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃবিজ্ঞান বিভাগে প্রভাষক হন এবং ২রা এপ্রিল ২০০৩ পর্যন্ত সেখানে শিক্ষকতা করেন। পরবর্তীতে ৩রা এপ্রিল ২০০৩ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃবিজ্ঞান বিভাগে প্রভাষক হিসেবে যোগদান করেন। ৭ জানুয়ারি ২০১৯ সালে তিনি নৃবিজ্ঞানের অধ্যাপক হন। মৃত্যুকালে তিনি বিশ্ববিদ্যালয়টির অধ্যাপক হিসেবেেই কর্মরত ছিলেন। তার সহকর্মী ও নৃবিজ্ঞানী, শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক একেএম মাজহারুল ইসলাম তাকে “নিবেদিত প্রাণ নৃবিজ্ঞানী” হিসেবে উল্লেখ করেন।
গবেষণায় আগ্রহের জায়গা:
বিভাগের ওয়েবসাইট থেকে আমরা জানতে পারি জনাব মাহমুদের গবেষণার আগ্রহের জায়গা ছিল- এথনিসিটি, ব্যক্তি পরিচয় ও প্রান্তিকতা, উন্নয়ন ও উন্নয়নবাদ, নৃতাত্ত্বিক তত্ত্বের ক্রিটিকাল টার্ন ইত্যাদি।
উল্লেখযোগ্য কাজ:
তিনি ২ টি বইয়ের সহসম্পাদনা করেছেন। একটি বইয়ের শিরোনাম Selected Issues in Social Justice and Human Rights in Bangladesh। আরেকটি বইয়ের শিরোনাম Culture, Adaptation and Resilience: Essays on Climate Change Regime in South Asia। জনাব মাহমুদ ৬ টি বুক চ্যাপ্টার এবং ১২ টি জার্নালে গবেষণা নিবন্ধ প্রকাশ করেন। এছাড়া সমসাময়িক বিভিন্ন বিষয়ে অনলাইন ও পত্রিকায় বহু প্রবন্ধ লিখেছেন। বেশ কিছু অনুবাদও করেছেন তিনি।
মানবিকতায় রাশীদ মাহমুদ:
করোনার কঠিন মুহূর্তে আমাদের সমাজে মানবতা যখন পরাজয় বরণ করছিল তখন আমরা অনেককেই মানবিকতাকে জিতিয়ে দিতে দেখেছি। রাশীদ মাহমুদ ছিলেন সেই সারির একজন।
১লা এপ্রিল ২০২০ তাঁর ফেসবুকে আমরা দেখতে পাই, তিনি “করোনার অনুদান ও সেবা” প্রদানের জন্য উদ্বুদ্ধ করেছেন।
লিংক: https://m.facebook.com/story.php?story_fbid=10158141600222760&id=680667759
যার পরবর্তী কার্যক্রম হিসেবে ৩রা মে ২০২০ তাঁর ফেসবুকের মাধ্যমে দেখতে পাই, প্রায় ১১০ টি পরিবারের মাঝে ২০ কেজির উপহার (চাল, ডাল, আলু, তেল, পেঁয়াজ, রসুন, লবন ইত্যাদি ) সামগ্রীর ব্যাগ প্রস্তুত করা হয় এবং উপহার পৌঁছে দেয়া হয়। কাজটি স্যারের গ্রামের বাড়ির স্থানীয় হাজি ছৈয়দ আহমদ ফাউন্ডেশনের সৌজন্যে করা হলেও স্যারের সার্বিক অংশগ্রহণ ছিল।
লিংক: https://m.facebook.com/story.php?story_fbid=10158257206517760&id=680667759
অনলাইন শিক্ষা কার্যক্রমে মার্জিনাল শিক্ষার্থীদের অসুবিধার কথা বিবেচনা করে স্যারের অবস্থান ছিল সবসময়ই শিক্ষার্থীবান্ধব। ৩রা মে ২০২০ তিনি “অনলাইন শিক্ষা কার্যক্রম ও একটি মাটির ঘর” শিরোনামে তাঁর শিক্ষার্থীদের সমস্যার কথা তুলে ধরেন এবং সবার জন্য উপযোগী ব্যবস্থা গ্রহণের আহ্বান জানান। অনলাইন শিক্ষাকে বাধ্যতামূলক না করার পক্ষে মত দিয়ে শিক্ষার্থীবান্ধন মানসিকতার স্বাক্ষার রাখেন।
স্যারের পোস্ট থেকে একটি অংশ উল্লেখ করছি-
“ঢাকার বাইরে অবস্থিত একটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন শিক্ষার্থী। ১৯৯৬ সালে অতি দরিদ্র (নাকি বঞ্চিত?) পিতা যখন মারা যান তখন রেখে যান স্ত্রী, ৪ কন্যা ও তিন পুত্র। অর্থাৎ, আলোচ্য শিক্ষার্থীরা ১৯৯৬ সাল থেকে পিতৃহীন ৭ ভাই-বোন। অকুল পাথারে পড়ে যাওয়া চিরায়ত গ্রামবাংলার একজন মা কিভাবে ৭ সন্তানকে নিয়ে এতদূর আসলেন সে গল্প আজ থাক। কারণ, আমাদের অনেকের জীবনমানের বিচারে ‘এতদূর আসা’- এই শব্দদুটিকে কেবলই বঞ্চিত মানুষের সংগ্রাম আড়াল করার কিতাবি পায়তারা মনে হয়। শুধু একটি তথ্য দেই যে, আলোচ্য শিক্ষার্থীটিকে তার মা এতিমখানায় রেখে আসতে বাধ্য হন যেখানে কেটে যায় শিক্ষার্থীর শৈশবের ৮ বছর।
যাই হোক, শিক্ষার্থীটির চার বোনেরই বিয়ে হয়ে গেছে। তারাও কতদূর এগোলো বা পেছালো সে গল্পও থাক। এই গল্পের দৃশ্যপটে তারা না থাকাই বরং আমাদের জন্য স্বস্তির। দুই ভাইয়েরও বিয়ে হয়েছে। দুই ভাইই দিন মজুর। এক ভাইয়ের চার মেয়ে ও আরেক ভাইয়ের এক মেয়ে। ছোট্ট একটি জীর্ণ মাটির ঘরে ততোধিক ছোট-ছোট তিনটি কক্ষের একটিতে এক ভাইয়ের পরিবার, আরেকটিতে আরেক ভাইয়ের পরিবার এবং শেষটিতে শিক্ষার্থীর মা নাতনিদের নিয়ে থাকেন। লকডাউনের কিছুদিন আগেই এক ভাইয়ের একটি অপারেশনে ঋণের বোঝা পরিবারটির মাথায়।লকডাউনের আঘাতে পরিবারটি আর্থিকভাবে রীতিমতো দিশেহারা। তো, আমাদের উল্লেখিত শিক্ষার্থীটি কোথায় থাকে জানতে চান? বারান্দায় বেড়া দিয়ে।
যারা অনলাইন ক্লাসের বাধ্যবাধকতার কথা বলছেন তারা কি একটু দয়া করে জানাবেন যে এই শিক্ষার্থীটিকে যদি আমরা ডেটা সাপোর্ট দিয়েও দেই, তার বাড়িতে কি ক্লাসে মনোযোগ দেয়ার পরিস্থিতি রয়েছে? এই অবস্থা পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর হাজার-হাজার শিক্ষার্থীর।”
লিংক: https://m.facebook.com/story.php?story_fbid=10158259101507760&id=680667759
……………………
খলিলুল্লাহ মুহাম্মদ বায়েজীদ ও মো. রেদওয়ানুল ইসলাম বিভিন্ন সোর্স থেকে রাশীদ মাহমুদ স্যার সম্পর্কে একটি বিস্তারিত ধারনা উপস্থাপনের চেষ্টা করেছেন।