রিচুয়াল:
রিচুয়াল শব্দটি দ্বারা আমরা মূলত ধর্মানুষ্ঠান বা ধর্মীয় আচারকে বুঝি। “রীতি” শব্দটি প্রথম ইংরেজিতে ১৫৭০ সালে লিপিবদ্ধ করা হয় এবং ১৬ শতকের শেষ দিকে ধর্মীয় সেবা প্রদানের ক্ষেত্রে ব্যবহৃত হয়।
রিচুয়াল গুলি সাধারণত সামাজিক সংহতি বাড়ানোর জন্য কাজ করে। কারণ বেশিরভাগ ক্ষেত্রে আচার-অনুষ্ঠানের প্রাথমিক উদ্দেশ্য হল ব্যক্তির বিশ্বাস ব্যবস্থাকে গোষ্টির সাথে সামঞ্জস্য করা। আচারের মাধ্যমে একটি বিশেষ ব্যবস্থা যতবেশি প্রণীত হয়, ততো বেশি শক্তিশালী হয়। এটি যত কম প্রণয়ন করা হয় ততো বেশি দুর্বল হয়ে পড়ে।
রিচুয়াল স্বেচ্ছাচারী নয় এগুলো একটি গোষ্ঠীর বিশেষ ব্যবস্থা থেকে আসে। নৃবিজ্ঞানী ভিক্টর টার্নার বলেন- রিচুয়াল হল বিভিন্ন কর্মকান্ডের একটি ধারাবাহিক ছাঁচ। একটি পৃথক স্থানে এটি পালন করা হয়। বিভিন্ন ইশারা-ইঙ্গিত, অঙ্গ-ভঙ্গী, কথা -উক্তি, বচন এবং বস্তু দ্বারা এটি পালন করা হয় ।
রিচুয়াল মাধ্যমে মানুষ বুঝতে পারে যে, এই জনগোষ্ঠী একই রিচুয়াল পালন করে। যেমনঃ মুসলমানরা শিশু জন্মের সাতদিন পর আকিকা পালন করে শিশুর নাম রাখে। মূলত- রিচুয়াল একটি জনগোষ্ঠীকে এক করে দেয় । এছাড়া এর মাধ্যমে আমরা ঐ গোষ্ঠী বা কিছু সংখ্যক লোকের মধ্যে বেশ পরিবর্তন লক্ষ্য করি। যেমন- কেউ হজ্জ করে আসলে আমরা তার মধ্যে অনেক পরিবর্তন দেখতে পাই।
এই রিচুয়াল মূলত আমরা সামাজিক ভাবে পালন করে থাকি। আমাদের বাংলাদেশে বিভিন্ন ধরনের রিচুয়াল পালন করা হয়ে থাকে যেমন: আকিকা, বিয়ে, সুন্নতে-খাতনা, শবে বরাত, শবে মেরাজ, হালখাতা, নবান্ন উৎসব, বিভিন্ন ধরনের মিলাদ, মুসলিম কারো মৃত্যুর পর কুলখানি, চল্লিশা ইত্যাদি। হিন্দুরা কারো মৃত্যুর পর শ্রাদ্ধ ইত্যাদি পালন করে থাকে। যা কেউ ইচ্ছে করলে পালন করতে পারে না, তার জন্য নির্দিষ্ট কারণ বা সময় নির্ধারিত হতে হয়।
এছাড়া বিভিন্ন কুসংস্কার যা আজও রীতি হয়ে চলে আসছে যেমন কুদৃষ্টি থেকে বাঁচার জন্য নবজাতকের কপালে কালো টিপ দেওয়া হয়, গলায় অনেকে তামার তাবিজ পরে। আবার অনেকে মনে করে খালি কলস, ঝাটা, বেজোড় শালিক পাখি, কাক, সামনে দিয়ে কালো বিড়াল গেলে যাত্রা অশুভ হয়।
এছাড়া প্রকাণ্ড বট গাছের নিচ দিয়ে রাতের বেলায় লোকেরা চলাচল করতে ভয় পায়। কারণ তাদের ধারনা ঐসব গাছের আড়ালে জিন-ভূত লুকিয়ে থাকে।
উপরোক্ত বিষয়গুলো ছাড়াও বিভিন্ন সংস্কৃতির মানুষ বিভিন্ন ধরনের রিচুয়াল পালন করে থাকে, যা দেখে মূলত আমরা এক সংস্কৃতি থেকে অন্য সংস্কৃতিকে আলাদা করতে পারি।
প্রত্যেকটা রিচুয়াল এর তিনটি ধাপ রয়েছে। যেমন :
- Pre-Liminality
- Liminality
- Post- Liminality
আমাদের সমাজে বিভিন্ন ধরনের রিচুয়াল্স থাকা সত্ত্বেও আমি মুসলমানদের অন্যতম একটি ধর্মীয় আচার “আকিকা” সম্পর্কে আমার ব্যক্তিগত অভিমত তুলে ধরতে যাচ্ছি। যার জন্য আমি রিচুয়াল্স এর যে তিনটি ধাপ রয়েছে তা অনুসরণ করে লিখতে চাই।
আকিকা:
আকিকা অর্থ হচ্ছে কাটা বা পৃথক করা। পারিভাষিক অর্থে বাচ্চা জন্ম লাভের কৃতজ্ঞতা আদায়ার্থে যে পশু জবাই করা হয় তাকে আকিকা বলে। মুসলমানগণ তাদের নবজাতক সন্তানের মঙ্গলের জন্য পরিবার ও গরিব-দুঃখীদের উদ্দেশ্যে ছাগল, ভেড়া অথবা গরু জবাই করে মাংস বন্টন করে দেয় অথবা ঐ মাংস দ্বারা ভোজের আয়োজন করা হয়।
সাধারণত আমাদের সমাজে শিশু জন্মের সপ্তম দিনে আকিকা করা হয়ে থাকে তবে কেউ যদি সপ্তম দিনে আকিকা করতে সক্ষম না হয় তবে পরবর্তীতে সন্তানের যৌবনের আগে যে কোন সময় আকিকা করতে পারে।
যেহেতু শিশু জন্মের সপ্তম দিনে আকিকা করা হয় কাজেই শিশু জন্মের পর ষষ্ঠ দিন পর্যন্ত আমরা আকিকার Pre-Liminality হিসেবে ধরতে পারি। কেননা এ সময় মা ও শিশুকে কিছু বিশেষ রীতির মাধ্যমে চলতে হয়। যেমন :
- আকিকার আগে পিতা-মাতা সন্তান এর নাম রাখে না।
- সন্ধাবেলা নবজাতক এবং নবজাতকের মা ঘর থেকে বের হয় না।
- রাতের বেলা মা ও নবজাতক যে ঘরে থাকে সেই ঘরের দরজা-জানালা সম্পূর্ণ বন্ধ করে রাখা হয়।
- মঙ্গলার্থে নবজাতকের মাথার কাছে পেরেক এবং ম্যাচ রাখা হয়।
- বাড়িতে রাতের বেলায় কোন ভাজাপোড়া বা রান্নাবান্নাও অনেকে করে না ।
- নবজাতকের মাকে মাছ, মাংস, লাউ, টক জাতীয় খাবার খেতে নিষেধ করা হয়।
- অনেক অঞ্চলে নবজাতক এবং নবজাতকের মা যে ঘরে থাকে সাতদিন পর্যন্ত ওই ঘরে কাউকে প্রবেশ করতে দেওয়া হয় না।
এছাড়াও বিভিন্ন ধরনের কুসংস্কার পালন করে থাকে গ্রামীণ জনগোষ্ঠীর মানুষ।
এছাড়া এ পর্যায়ে আকিকা করার জন্য সকল প্রকার পূর্ব প্রস্তুতি গ্রহণ করা হয়ে থাকে যেমন: পিতামাতাকে সঠিক নিয়ত করতে হব। তাদের সামর্থ্য অনুযায়ী তারা কিভাবে আয়োজন করবে তা ঠিক করা হয়ে থাকে। যদি আয়োজন বড় করে করা হয় তবে এই ৬ দিনের মধ্যে সকল আত্মীয় স্বজনদের দাওয়াত দেওয়া সম্পন্ন হয়।
এখন আমি আমার যে অভিজ্ঞতার বর্ণনা করব তাকে আমি Liminality বলতে পারি। কেননা এই অনুষ্ঠানের জন্য যে পূর্ব প্রস্তুতি নেয়া হয়েছিল তার কার্য এই সপ্তম দিনে সম্পন্ন হয়ে থাকে। যেমনঃ
- শিশুর জন্ম উপলক্ষে যে পশু জবাই করা হয় তা গরিব-দুঃখীদের বন্টন করার পাশাপাশি বাড়িতে আত্মীয় স্বজনদের দাওয়াত করে খাওয়ানো হয়।
- শিশুর মাথা ন্যাড়া করে মাথায় যে পরিমাণ চুল হয় তার ওজন দিয়ে সমপরিমাণ স্বর্ণ বা রুপার ওজন অনুসারে তার টাকা গরিব দুঃখীদের মাঝে বিলি করে দেওয়া হয়।
- শিশুর নাম রাখা হয় মূলত এই দিনেই।
- মা ও শিশুকে যারা দেখতে আসে তারা তাদের জন্য বিভিন্ন উপহার সামগ্রী নিয়ে আসেন।
- মা ও শিশুকে অবশ্যই এই দিনে গোসল করতে হয়।
এছাড়া অনেক অঞ্চলে একটি কুসংস্কার এখনও বিদ্যমান আছে সেটি হল আকিকার মাংস নবজাতকের পিতা-মাতা খেতে পারবে না। যা কোন ধর্মীয় রীতি না থাকা সত্বেও কু-সংস্কার হিসেবে যুগ যুগ ধরে অনেকে ধর্মীয় রীতি মনে করে পালন করে আসছে।
মূলত রিচুয়াল্স এর এই পর্যায়টি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ কেননা মূল অনুষ্ঠানটি কয়েকটি পর্যায়ে সম্পন্ন হয়। এ পর্যায়ে নবজাতক এবং তার মাকে যে রীতি পালন করতে হয় তা হয়তো আমরা শুধু চোখে দেখতে পারি কিন্তু অনুভব করার সক্ষমতা রাখি না।
এর পরের পর্যায়টিকে আমি Post-Liminality হিসেবে ব্যাখ্যা করতে পারি। কেননা এই পর্যায়ে মা ও শিশু স্বাভাবিক নিয়মে চলতে পারে। শিশুর নাম রাখা হয়ে যায় কাজেই শিশুটিকেও সকলে নাম ধরে ডাকতে পারে। এছাড়া শিশুর পিতা মাতা মনে করে আকিকা সম্পন্ন হয়ে গেছে এখন শিশুর বিপদ-আপদ বা অসুখ-বিসুখ কম হবে। এটা মূলত যার যার অন্তরে বিশ্বাস।
মূলত প্রত্যেকটা রিচুয়াল্স এর মাধ্যমে আমরা সকলের মধ্যে কম বেশি পরিবর্তন লক্ষ্য করি এবং এই রিচুয়াল্স গুলো আমরা মন চাইলে পালন করতে পারি না।
আমি আমার নিজস্ব যে অভিজ্ঞতার কথা বর্ণনা করলাম তা হলো “আকিকা”। এটি মূলত একটি নিয়মের মাধ্যমে পালন করা হয় এবং এর মাধ্যমে আমরা অনেক পরিবর্তন লক্ষ্য করি ।
তবে আমি যে বর্ণনা করেছি তা অন্য জনের সাথে পার্থক্য থাকতে পারে। কেননা অঞ্চলভেদে কিছু ধর্মীয় আচার এর মধ্যে অনেক কুসংস্কার পালন করা হয়ে থাকে।
পরিশেষে আমি একথা বলতে চাই যে- রিচুয়াল্স আমাদের জীবনের সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িত এবং একে বাদ দিয়ে আমরা চলতে পারি না। কেননা সমাজে বসবাস করতে হলে আমাদের সমাজের নিয়ম পালন করেই চলতে হয়।
……………………………………………..
লেখক: শাহানাজ আক্তার, শিক্ষার্থী, সমাজবিজ্ঞান ও নৃবিজ্ঞান বিভাগ, শান্ত-মারিয়াম ইউনিভার্সিটি অব ক্রিয়েটিভ টেকনোলজি।
[লেখার সকল দায়বদ্ধতা লেখক নিজে সংরক্ষণ করবেন।]
The writer have arised many historical points that we did not know.