Print Friendly, PDF & Email

(ইসলাম ধর্মের পাঁচটি স্তম্ভের মধ্যে রোযা বা রামাদান একটি। এই রোযাকে কেন্দ্র করে বিশ্বের বিভিন্ন সমাজে নানা ধরনের ঐতিহ্য গড়ে উঠেছে। দক্ষিণ এশীয় অঞ্চলে রোজাদারদের সেহরির জন্য ঘুম থেকে জাগিয়ে তোলার এক ধরনের ঐতিহ্য দেখা যায়। এটিকে “সুহুর সংস্কৃতি”ও বলা যায়। পায়ে হেঁটে হেঁটে ঢোল পিটিয়ে, উচ্চস্বরে স্রষ্টার প্রশংসামূলক গান, ও ক্বাসীদা গেয়ে বিশ্বাসী মানুষজনকে মধ্যরাতে জাগাবার এই ঐতিহ্য বর্তমানে বিলীনের পথে। এ সম্পর্কে আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম আলজাজিরায় “Ramadan: South Asia’s dying traditions on waking up the faithful” শিরোনাম একটি সংবাদ প্রকাশ করে। ধর্ম বিষয়ক সংবাদটির মূল প্রতিবেদক হলেন মাজিদ মকবুল, নিলীমা পাঠক ও ফয়সাল মাহমুদ।

এতে ভারতের কাশ্মীর ও নয়াদিল্লির “সাহার খান” ঐতিহ্য এবং বাংলাদেশের পুরান ঢাকার ক্বাসীদা প্রথার অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যৎ নিয়ে তথ্যনির্ভর আলোচনা করা হয়েছে। পাশাপাশি এ মহৎ কাজে যুক্ত ব্যাক্তিদের মনোভাব ও যুক্ততার প্রেক্ষিতসহ নানাবিধ প্রসঙ্গ উপস্থাপন করা হয়েছে।)

Anthrobd – An Initiative for Research and Development’র পাঠকদের জন্য লেখাটি ভাষান্তর করেছেন খলীলুল্লাহ মুহাম্মাদ বায়েজীদ ও সুমাইয়া হাসিন।

………………………………………

এখন মুসলমানদের পবিত্র রমজান মাস চলছে। এই মাসে বিশ্বাসী মানুষজন সূর্যোদয় থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত রোজা পালন করেন বা অভূক্ত থাকেন। রোজা বলতে তাকওয়া বা আল্লাহ ভীতি অর্জন করার উদ্দেশ্যে খাদ্য, পানাহার, ধূমপান এবং দৈহিক সম্পর্ক থেকে বিরত থাকাকে বোঝায়। ১,৪০০ বছর পূর্বে নবী মুহাম্মদ সা. উপর যে মাসে ইসলাম ধর্মের পবিত্র গ্রন্থ কুরআনের প্রথম আয়াত নাযিল হয়েছিল- সেই মাসকে নিশানা করে রোজা রাখা হয়।

মুসলমানরা এই মাসে রোজা রাখার জন্য খাবারের উদ্দেশ্যে ভোররাতে ঘুম থেকে ওঠেন। এটিকে সেহরি বলে। এবং সূর্যাস্তের সাথে সাথে তারা ইফতারের সাথে রোজা ভাঙ্গেন। এরপরে মুসলমানরা গভীর রাত পর্যন্ত বিশেষ নামাজ আদায়ে নিমগ্ন থাকেন। ভোররাতে সেহরির জন্য বিশ্বাসী মানুষকে জাগিয়ে তোলার বিভিন্ন চর্চা বিশ্বজুড়ে বেশকিছু ঐতিহ্যের জন্ম দিয়েছে। বিশ্বের মুসলিম জনগোষ্ঠীর এক-তৃতীয়াংশের বসবাস দক্ষিণ এশিয়ায়। এ অঞ্চলে রোজাদারদের জাগিয়ে তোলার বেশ কিছু চমৎকার অথচ বর্তমানে মৃতপ্রায় ঐতিহ্য রয়েছে। এর মধ্যে বেশ কয়েকটি প্রথা উদাহরণসহ তুলে ধরা হলো।

কাশ্মীরের সাহার খান:

ভারত শাসিত কাশ্মীরের পুলওয়ামা জেলার কইল এ বসবাসকারী একজন মুসলিম তারেক আহমেদ শেখ (১৮)। তিনি রোজার প্রায় প্রতিদিন ভোর রাত ২ টা ৩০ মিনিটে তার বাবা শওকতের (৫৫) সাথে ঘর থেকে বেরিয়ে পড়েন। ঘর থেকে বের হয়ে তারা দু’জন গ্রামের অন্ধকার ও গলি পথ ধরে এগিয়ে যান। গলায় ঢোল ঝুলিয়ে ও হাতে দু’টি ঢোলের কাঠি নিয়ে উচ্চস্বরে “ওয়াকত-ই-সাহার” বা “সেহরির সময় হয়েছে, উঠুন” এই বলে ডাকতে থাকেন। এভাবে ঢোল পিটিয়ে বাবা-ছেলের জুটি পাড়ার বাসিন্দাদের ঘুম থেকে জাগিয়ে তোলেন। এভাবে প্রায় ৫ কিলোমিটারের (২.২ মাইল) মতো রাস্তা হেঁটে আনুমানিক ২০০ পরিবারকে জাগিয়ে তুলে এক ঘন্টা পর নিজেদের ঘরে ফিরে তারা একসাথে সেহরি খান।

[সেহরির সময় আশেপাশের মুসলিমদের ডেকে জাগানোর জন্য] মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ হিমালয় এই অঞ্চলে তারিক ও শওকত সাহার খান নামে পরিচিত। বছরের বাকি সময় ধরে জীবিকা নির্বাহের জন্য মজুরী শ্রমে কাজ করা শওকত বিশ বছরেরও বেশি সময় ধরে রমজান মাসে সাহার খান হিসাবে কাজ করছেন। তিনি এই কাজটি [সেহেরিতে জাগানো] তাঁর পিতার কাছ থেকে উত্তরাধিকারসূত্রে পেয়েছেন। বিগত ৩ বছর যাবৎ শওকত তার ছেলে তারিকের সহচর হিসেবে যাচ্ছেন। এর মধ্য দিয়ে তিনি তার ছেলেকে একাজের নৈপুণ্য শিখিয়ে চলেছেন যাতে করে তারিক ঐতিহ্যটিকে এগিয়ে নিয়ে যেতে পারে।

বর্তমান সময়ে অ্যালার্ম ঘড়ি এবং স্মার্টফোনগুলো তাদের কাজকে ব্যাপকভাবে প্রভাবিত করার পাশাপাশি তাদের উপার্জনও কমেছে। শওকত বলেন, তারা এই “মহৎ কাজ” করে যাচ্ছেন কারণ এটি তাদের “সওয়াব”বা পূণ্য দেয়। এ ছাড়া তারা সাহার খানের ঐতিহ্যকে বাঁচিয়ে রাখতে চান। শওকত আল জাজিরাকে আরো বলেন “যদিও কিছু লোক চায় না যে আমরা তাদেরকে বিরক্ত করি এবং আমরা এখন এই কাজ থেকে কিছুটা কম উপার্জন করি; তবুও আমরা প্রতি রমজানে এই কাজটি চালিয়ে যাব।”

সাহার খানরা পবিত্র রমজান মাসের শেষে তাদের আশেপাশের বাসিন্দাদের বাড়ি বাড়ি যান এবং মানুষজন তাদের কাজের জন্য যা কিছু দেয় তা গ্রহণ করেন। বেশিরভাগ সময়ই লেকেরা তাদের চাল এবং কিছু পরিমাণ এর টাকা প্রদান করে থাকেন টাকা দিয়ে থাকেন। আর নগদ টাকার পরিমান ৫০০০-১০০০০ রুপীর মধ্যে হয়ে থাকে, যা ৬৮-১৩৬ ইউএস ডলারের সমান।

উত্তর কাশ্মীরের হাজিন গ্রামের নাজির আহমেদ প্যারেই। ৪৮ বছর বয়সী প্যারেই সাহার খান হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। তিনি বলেন, তাঁর বাবা প্রায় ৭০ বছর এ দায়িত্ব পালন করেন। তিনি মারা যাওয়ার পূর্বে তার [পারে] এবং তার ছোট ভাইয়ের কাছে এই গুরু দায়িত্ব অর্পণ করে যান। প্যারেই বলেন, “মৃত্যুর আগে বাবা আমাদের পরামর্শ দিয়েছিলেন এই ঐতিহ্যটি ধরে রাখার জন্য। যদিও আমরা প্রত্যেকে এর থেকে খুব বেশি অর্থ উপার্জন করি না; তবুও তিনি আমাদেরকে এটিকে একটি ঐশ্বরিক কাজ হিসাবে দেখার পরামর্শ দিয়েছিলেন, যার প্রতিদান পরকালে রয়েছে।”

নাজির আহমেদ প্যারেই ৩০ বছর ধরে সাহার খান হিসেবে কাজ করছেন। তিনি বলেন, “সেহরির জন্য মানুষজন ঘুম থেকে জাগার ক্ষেত্রে আগে যেমন প্রত্যাশা করতো, [প্রযুক্তি ব্যবহারের জন্য] বর্তমানে মানুষজন তাদের আগমনের জন্য আর অপেক্ষা করে না। অর্থাৎ অ্যালার্ম ঘড়ি এবং স্মার্টফোন ব্যবহারের মাধ্যমে উঠে। “যদিও কিছু লোক মধ্যরাতে [আমাদের এ কাজের মাধ্যমে] বিরক্ত করতে চায় না, আবার কেউ কেউ আছেন যারা আমাদের ঐতিহ্যটি জারি রাখতে চান এবং রমজানের সময় তাদের অঞ্চলে আসার আহ্বান জানান,” প্যারেই আল জাজিরাকে বলেন। নাজির আহমেদ প্যারেই জানান এ কাজে তাঁর তরুণ ভাতিজারা এখন তাকে সঙ্গ দেন। এখন তিনি তাদের শিখাচ্ছেন কীভাবে সঠিকভাবে ঢোল পিটিয়ে মানুষকে সেহরির জন্য জাগিয়ে তুলতে হয়।

১৯৯০-এর দশকে বিতর্কিত ভূখণ্ডে ভারতীয় শাসনের বিরুদ্ধে সশস্ত্র বিদ্রোহ শুরু হওয়ার পর পরিবেশ অশান্ত হয়ে পরে। নাজির আহমেদ পারে এ ঘটনার একজন প্রত্যক্ষদর্শী। মূলত কাশ্মিরের কিছু অংশ শাসন করার সময় ভারত ও পাকিস্তান উভয় রাষ্ট্র এ ভূখণ্ডের পুরোপুরি শাসন দাবি করাকে কেন্দ্র করে এ সশস্ত্র বিদ্রোহ শুরু হয়েছিল। সে সময়ে দ্বন্দ্ব-সংঘাত তীব্র হওয়ার সাথে সাথে রাতের বেলা স্থানীয় প্রশাসনের দ্বারা আরোপিত নিষেধাজ্ঞাগুলো এখনো নাজির আহমেদ পারের মনে আছে। সামরিক কঠোরাবস্থা আরোপ [ক্র্যাকডাউন] এবং বাড়িতে যে কোন সময় হানা দেওয়া ছিল নিত্যনৈমত্তিক ঘটনা। এমন উদাহরণও ছিল যখন তাঁর মতো সাহার খানদের টহলদার সৈন্যরা থামিয়ে দিত। এবং মধ্যরাতে তাদের চলাফেরা সম্পর্কে বিভিন্ন ধরনের প্রশ্ন করা হত। প্যারেই আল জাজিরাকে আরো বলেন “মাঝে মাঝে আমাদের রমজানের আগে মধ্যরাতের চলাফেরার জন্য নিকটস্থ সেনা শিবিরকে জানাতে হতো, যাতে করে তারা আমাদের কাজে বাধা না দেয়।”

সাম্প্রতিক সময়ে, ২০১৯ সালের ৫ ই আগস্ট, নয়াদিল্লি ভারত-শাসিত কাশ্মীরের বিশেষ মর্যাদাকে ছিনিয়ে নেয়। পুরো কাশ্মীর এক-মাসব্যাপী বন্ধ এবং যোগাযোগ অবরোধের মধ্যে পরে যায়। এ ধরনের বিরুপ অবস্থা সাহার খানদের চলাচলকে সীমাবদ্ধ করে দেয়। পরবর্তীতে করোনা ভাইরাস মহামারীজনিত কারণে দেওয়া লকডাউন এই অবস্থাকে আরো দীর্ঘায়িত করেছে। তবে সাহার খানরা বলেছেন, এই ধরনের বিধিনিষেধগুলি তাদের ঐতিহ্যবাহী কাজ চালিয়ে যাওয়া থেকে বিরত রাখতে পারেনি।

[কিন্তু প্রশ্ন আসে এ ধরনের ঐতিহ্য প্রথা কাশ্মীরে কোন অঞ্চল থেকে এসেছিল বা এর উৎপত্তি কোথায়? এর উত্তরে] বিশিষ্ট কাশ্মীরি কবি ও সাংস্কৃতিক কর্মী জারিফ আহমদ জারিফ বলেন, সাহার খানের ঐতিহ্য মধ্য এশিয়া থেকে কাশ্মীর অঞ্চলে এসেছিল। শৈশবের স্মৃতিচারণ করে তিনি আরো বলেন, এই অঞ্চলের প্রধান শহর পুরো শ্রীনগরের জন্য কেবল একজন সাহার খান ছিলেন। তার নাম গোলাম মোহাম্মদ বেঙ্গী।জারিফ বলেন, বেঙ্গী পায়ে হেঁটে অনেক পথ পারি দিতে পারতেন। তিনি একটি কুণ্ডলী আকারের ভেড়ার ফাঁকা শিং-এ ফুঁ দিয়ে উচ্চ আওয়াজ তৈরি করে মানুষকে জাগিয়ে তুলতেন। জারিফ আরো বলেন, “মধ্যরাতে শ্রীনগরের ফাঁকা রাস্তায় হেঁটে হেঁটে তিনি অত্যন্ত চমৎকারভাবে নবী মুহাম্মদ সা.-এর শানে না’ত গাইতে পারতেন। সে সময় অনেক মানুষ, বিশেষ করে শিশুরা তার এই আওয়াজটি শোনার জন্য অপেক্ষা করতেন। কোন কোন সময় তারা রাস্তায় বেরিয়ে এসে এবং জানালার ধারে এসে তাকে একপলক দেখার জন্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করতেন।

জারিফের মতে, বর্তমানে মানুষজন [সেহরিতে জাগার জন্য] অ্যালার্ম ঘড়ি এবং স্মার্টফোনের উপর নির্ভর করা সত্ত্বেও কোনও আধুনিক গ্যাজেট সাহার খানকে প্রতিস্থাপন করতে পারে নি। তিনি আরো বলেন, “আজ আমাদের কাছে অ্যালার্ম ঘড়ি এবং সর্বশেষতম স্মার্টফোন থাকলেও আমরা রমজানের সময় প্রতি বছর সেহরির সময়ে সাহার খানদের দেখতে এবং শুনতে পাই। কাশ্মীরীদের কাছে সাহার খান ছাড়া রমজান অসম্পূর্ণ। তারা এই পবিত্র মাসের অভিজ্ঞতাকে আরো সমৃদ্ধ করে। “

পুরানো দিল্লির শহুরে নকীব:

৪৬ বছর বয়সী ফরিদ আহমেদ একটি অলৌকিক ঘটনার অপেক্ষায় আছেন। ভারতের রাজধানী নয়াদিল্লির অন্যান্য বাসিন্দাদের মতো তিনিও হঠাৎ করেই কোভিড-১৯ বেড়ে যাওয়া নিয়ে উদ্বিগ্ন। মহামারীটি রমজান উদযাপনকে ক্ষতিগ্রস্থ করেছে। প্রায় দুই কোটিরও বেশি বাসিন্দার শহরটি এখন লকডাউনের আওতায়। আহমেদ আল জাজিরাকে বলেন, এ পরিস্থিতি অব্যাহত থাকলে সেহরির জন্য মানুষজনকে জাগ্রত করার ঐতিহ্যটি শীঘ্রই ইতিহাসে পরিণত হবে।” ধর্মপ্রাণ মানুষদের সেহরির জন্য ঘুম থেকে জাগাতে শহরের রাস্তায় ঘুরে ঘুরে আহ্বানকারী অল্প কয়েকজন ব্যক্তিদের মধ্যে তিনি একজন। এদেরকে “মুনাদী” [আহ্বানকারী] বা শহুরে নকীব হিসেবে অভিহিত করা হয়।

দিল্লির পুরানো অংশগুলো মোগল সম্রাটের আসন এবং বর্তমানে পুরাতন দিল্লি হিসাবে বেশি পরিচিত। ১৯৮০’র দশকেও এই শহরে অসংখ্য “মুনাদী” ছিলেন। এ এলাকার বাসিন্দারা তাদেরকে টাকা-পয়সা ও সুস্বাদু খাবার প্রদান করতেন। কিন্তু অ্যালার্ম ঘড়ি এবং স্মার্টফোনগুলির মতো আধুনিক গ্যাজেটগুলো তাদের এই সেবার ক্ষেত্রকে সংকুচিত করেছে। তবে এখনও অল্প কয়েকজন মানুষ নিঃস্বার্থভাবে স্বেচ্ছাশ্রমে এ ঐতিহ্যটি চলমান রাখার চেষ্টা করছেন। ২০১৫ সালে আহমেদের ওস্তাদ অসুস্থ হয়ে পড়েন। তিনি শাস্ত্রীয় গান ও সংগীত বিশেষজ্ঞ হিসেবে বিশেষ সম্মানে ভূষিত ছিলেন। আহমেদ বলেন, “তিনি চেয়েছিলেন আমি যেন “মুনাদি”র কাজ করি। তখন থেকেই নিরবিচ্ছিন্নভাবে আমি এই গুরু দায়িত্ব পালন করে যাচ্ছি।”

একটি কোর্তা-পাজামা এবং ছোট টুপি পরে আহমেদ লাল কুয়ান বাজার, ফরাশ খানা ও রাকবগঞ্জ এলাকার খালি রাস্তাগুলি ঘুরে বেড়িয়ে সেহরিতে ওঠার জন্য অধিবাসীদের ডাকতে থাকেন। এক্ষেত্রে অন্য কোনও মুনাদির অঞ্চলে প্রবেশ না করার বিষয়ে সতর্ক থাকেন। [যাতে করে কোনো এলাকা বাদ না পড়ে যায় কিংবা কোন এলাকার মানুষজন ২ বার ডাক শুনে বিরক্ত না হন।] মানুষজনকে জাগানোর জন্য তিনি কুরআন তিলাওয়াতের পাশাপাশি বুনিয়াদি সূত্র থেকে গুণকীর্তন করেন। রমজানের প্রথম দিনগুলোতে এসব গুণকীর্তনগুলোতে পবিত্র মাসকে স্বাগত জানানো হয়। আর শেষের দিকের বিষয়বস্তু থাকে “আলবিদা” বা বিদায় গীত।

আহমেদ বলেন, “পরিবার ও বন্ধুদের মধ্যে আধ্যাত্মিক প্রবণতা ও আলেমদের প্রতি শ্রদ্ধা রেখেই আমরা এ কাজ করছি। আমাদের অনেকেই দল বেধে বের হয়। তবে এই সবকিছুই [করোনা ভাইরাসের কারণে] আপাতত স্থবির হয়ে পড়েছে।” রিয়েল এস্টেট ডেভেলপারের সাথে যুক্ত আহমেদ সম্প্রতি চাকরি হারিয়ে এই “মুনাদি”র দায়িত্ব নিষ্ঠার সাথে পালন করছেন।

আরেকজন মুনাদী হলেন ৭২ বছর বয়সী লায়েক খান। তিনি পুরান দিল্লির তেলিওয়ারার একজন বাসিন্দা। “গত বছরের লকডাউন সকল উৎসব নষ্ট করে দিয়েছে। এ বছর আমরা আশাবাদী ছিলাম। কিন্তু স্বাভাবিকভাবে ইফতার আয়োজনের প্রত্যাশা আবারো ভেঙ্গে চুরমার হয়ে গেছে”- আল জাজিরাকে লায়েক খান বলেন। রাত আড়াইটার দিকে শুরু করে লায়েক খান ২০ বছরেরও বেশি সময় ধরে “মুনাদি” ঐতিহ্যের প্রচার করে চলেছেন। এক হাতে একটি টর্চ লাইট এবং অন্য হাতে একটি লাঠি ধরে তিনি সিস গঞ্জ এবং কিশন গঞ্জের অধিবাসীদের সেহেরির সময় সম্পর্কে সতর্ক করেন।

তিনি হেসে বলেন, “একজন ফল বিক্রেতা হওয়ায় আমার কণ্ঠ রোযাদারদের ঘুম থেকে জাগানোর জন্য উপযুক্ত ছিল।” তার উচ্চস্বরের আহ্বান পাড়ার সবার কাছে পরিচিত। অনেকেই তাকে এ কাজের জন্য বাহবা দেয়। কেউ তাকে নগদ অর্থ প্রদান করে। অনেকেই আবার তাকে সুস্বাদু খাবার দেয়। পাড়ার অনেকেই তাকে নিজেদের বাচ্চার নাম ধরে ডাকার অনুরোধ করেন। এতে করে মানুষজন, বিশেষকরে বাচ্চারা অনেকবেশি আনন্দিত ও উল্লাসিত হয়। তবে লায়েক খান জানান, “গোপনীয়তা রক্ষার জন্য বা রোযা না রাখতে পারা প্রবীণ এবং শিশুদের ঘুমে ব্যাঘাত না ঘটানোর বিষয়টি মাথায় রেখে সাম্প্রতিক সময়ে অনেকেই তাদের নাম ধরে না ডাকতে অনুরোধ করতে শুরু করেছেন।” খান বলেন, তিনি এ কাজ থেকে বেশি আর্থিক সুবিধা প্রত্যাশা করেন না। “আমাদের পূর্বপুরুষেরা পূণ্যের (আধ্যাত্মিক পুরষ্কার) জন্যই এ কাজে যুক্ত ছিলেন।”

বাংলাদেশের বিলীন হয়ে যাওয়া কাসিদা ঐতিহ্য:

বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকায় পুরান ঢাকার সরু গলিগুলোতে রোজাদারদের জাগানোর জন্য প্রায় রাত দুটোর দিকে একদল স্বেচ্ছাসেবক গান গাওয়া শুরু করে। এই গানগুলো উর্দু কবিতার কাসিদা ঘরানার এবং যার সম্পূর্ণ অংশ রমজান কেন্দ্রিক। এসব গায়কদের পৃষ্ঠপোষকতা করে পাড়ার প্রভাবশালী পরিবারগুলো। পুরান ঢাকায় মুঘল আমল থেকেই এই কাসিদা গানের একটি সমৃদ্ধ ঐতিহ্য ছিল। কিন্তু এই ঐতিহ্য বা প্রথা ক্রমান্বয়ে বিলীন হয়ে যাচ্ছে।

পুরান ঢাকার কাজিদেওয়ান এলাকার একজন চামড়া ব্যবসায়ী রাশেদ আল আমিন বলেন, রমজানের সময়ের কাসিদা ঐতিহ্যের মধ্যে তিনি বেড়ে উঠেছে। তিনি আল-জাজিরাকে বলেন, “আমার এখনো একটি কাসিদা গানের কিছু লাইন মনে আছে।” রাশেদের নানা নান্নু সরদার ছিলেন এ রকমই মহল্লার একজন নেতা। রাশেদ বলেন, “আমার ছোটবেলায় প্রায়ই দেখতাম রমজান মাস শুরুর আগে একদল কাসিদা সঙ্গীতশিল্পী আমাদের বাড়িতে আসতো আমার নানার আশীর্বাদ নিতে। তখন এই সব শিল্পীদের পৃষ্ঠপোষকতা করার একটা সংস্কৃতি প্রচলিত ছিল।” তিনি আরো বলেন, স্যাটেলাইট টিভি, ইন্টারনেট এবং সামাজিক মাধ্যমগুলোর উদ্ভবের ফলে অনেক মানুষ, বিশেষ করে যুবকরা সেহেরির আগে খুব কমই ঘুমায়। তিনি বলেন, “আগে এটা এমন ছিলনা, তারাবির নামাজের [রোজার রাত্রিকালীন নামাজ] পরে মানুষ ঘুমাতে যেতো।” তাদেরকে জাগানোর জন্য কাসিদা শিল্পীরা আবেগময় গান গাইতো যার অধিকাংশই ইন্ডিয়া পাকিস্তান থেকে সংগ্রহীত জনপ্রিয় উর্দু কবিতা অংশ। রাশেদ বলেন, “১৯৮০’র দশকের শুরুর দিকে এ সকল শিল্পীদের অনেকেই বাংলায় গান লেখা শুরু করেন। কিন্তু কাসিদা সঙ্গীতগুলো প্রধানত উর্দু ভাষায়।”

আজিম বখস একটি সাংস্কৃতিক সংগঠন “ঢাকা কেন্দ্রে”র প্রধান। তিনি বলেন, এই ঐতিহ্য ধীরে ধীরে হারিয়ে যাওয়ার পেছনে একটি বড় কারণ হল সুউচ্চ ভবন। তিনি বলেন, “কাসিদা গানগুলো খুবই গায়ে গায় লেগে থাকা মহল্লার জন্য প্রযোজ্য যেখানে একটি সড়কের বা গলির উভয় পাশে দুই বা তিন তলা ভবন রয়েছে। কিন্তু বর্তমানে এই সকল ভবনগুলো সুউচ্চ ভবনে রুপান্তরিত হয়েছে এবং যৌথ পরিবার ভেঙ্গে অনু পরিবার হয়েছে। এভাবে কাসিদা সংস্কৃতির জায়গা এখন টিভি-ইন্টারনেট দখল করে নিয়েছে।” এর পাশাপাশি আজিম বখস আরো বলেন, কাসিদা গানগুলো মূলত উর্দুতে হওয়ায় অনেকে এটাকে অবাঙালী প্রথা মনে করেন। “কিন্তু এটি সত্য নয়। ঢাকার উর্দু পাকিস্তানের উর্দুর মতো নয়, কিছু বাংলা শব্দের মিশ্রণে এটি এক ধরনের চলিত রীতির উর্দু।”

এই গানের একজন শিল্পীর নাম শমসের রহমান। তিনি ঢাকার লালবাগ এলাকায় থাকেন। তিনি কাসিদা ঐতিহ্যকে ধরে রেখেছেন। রহমান মিয়ার শিক্ষক ছিলেন ওস্তাদ জুম্মন মিয়া যিনি ৬০ বছর কাসিদা শিল্পী হিসেবে কাজ করেছেন। ২০১১ সালে জুম্মন মিয়ার মৃত্যুর পর রহমান তার স্থলাভিষিক্ত হন। রহমান আল-জাজিরাকে বলেন, “আমি আমার ওস্তাদের কাছ থেকে কাসিদা গান শিখেছি। আমিও তার সাথে পুরান ঢাকার বিভিন্ন পাড়ায়-মহল্লায় গান করতাম।” তিনি আরো বলেন, “মানুষ আমাদেরকে উপহার এবং টাকা উভয়ই দিত। এর পাশাপাশি রমজানের শেষে অথবা ঈদুল ফিতরের দিন আমরা বখশিশ [আর্থিক উপহার] পেতাম।” রহমান আশাবাদী কাসিদা ঐতিহ্য পুরোপুরি হারিয়ে যাবে না। তিনি বলেন, “এখনো কিছু দল আছে যারা এই ঐতিহ্যকে চর্চা করছে। আমি বিশ্বাস করি এটি সময়ের পরীক্ষায় টিকে যাবে।”

মূল লেখার লিঙ্ক:

https://www.aljazeera.com/news/2021/5/6/ramadan-south-asias-dying-traditions-on-waking-up-the-faithful

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here