আমেরিকান নৃবিজ্ঞানী লেসলি এ. হোয়াইট ১৯০০ সালে কলোরাডোতে (Colorado) জন্মগ্রহণ করেন। তিনি মূলত ‘সাংস্কৃতিক বিবর্তন’ এবং ‘সংস্কৃতির বৈজ্ঞানিক অধ্যয়নে’র (Culturology) জন্য সুপরিচিত ছিলেন।
আমেরিকান এই নৃবিজ্ঞানীর নৃবিজ্ঞানে আসার পথটা এত সরল ছিল না। বহুপথ ঘুরে তাঁকে নৃবিজ্ঞানে আসতে হয়েছে। লেসলি হোয়াইট লুইসিয়ানায় যখন হাইস্কুলে ভর্তি হন তখন তাঁর ইচ্ছা ছিল তিনি পদার্থবিজ্ঞান এবং জ্যোতির্বিজ্ঞানে পড়াশোনা করবেন এবং এই বিষয়গুলোর উপরেই শিক্ষকতা করবেন । কিন্তু সেটা আর তখন হয়ে ওঠেনি । ১৯১৪ সালে প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শুরু হয়ে যাওয়ায় তাঁকে নৌবাহিনীতে যোগদান করতে হয়েছিল। তবে, প্রথম বিশ্বযুদ্ধের অভিজ্ঞতাই তাঁকে সমাজবিজ্ঞানের দিকে টেনে নিয়ে এসেছিল। যুদ্ধচলাকালীন সময়ে তিনি এমন কিছু অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে যান, যেগুলোর কারণে তিনি দাবি করেন যে, সমাজ কিংবা সমাজ সম্পর্কিত অন্যান্য বিষয়ে তিনি যা শিখেছিলেন তা আসলে ভুল ছিল। তিনি সমাজ সম্পর্কে সঠিকভাবে জানতে দৃঢ় প্রতিজ্ঞ হন।
তিনি ইতিহাস এবং পলিটিক্যাল সাইন্সে পড়াশোনা শুরু করেন। এরপর কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের মনস্তত্ত্ব, সমাজবিজ্ঞান,দর্শন নিয়ে পড়াশোনা করেন। ১৯২২ সালে মনস্তত্ত্বে বি.এ. এবং ১৯২৪ সালে মাস্টার্স ডিগ্রি লাভ করেন। কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নকালে তিনি নতুন কিছু ডিসিপ্লিন-এ ও পড়াশোনা করেন। সেগুলো হলো আচরণগত মনস্তত্ত্ব (Behaviaral Psychology), অর্থনীতি এবং নৃবিজ্ঞান।
সমাজবিজ্ঞান অধ্যয়ন করার জন্য তিনি শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয়ে যান। সেখানে অধ্যয়নকালে এডওয়ার্ড সাপির এবং ফে-কুপার কোল (fay-cooper cole) এর তাঁর সাথে সাক্ষাত হয়। লেসলি হোয়াইট সিদ্ধান্ত নেন যে তিনি তাঁর অধ্যয়নের বিষয় পরিবর্তন করবেন। তিনি মনে করতেন, সমাজবিজ্ঞানে বাস্তবের চাইতে তত্ত্বের প্রাধান্যই বেশি। সুতরাং, সিদ্ধান্ত নিলেন তিনি এখন থেকে নৃবিজ্ঞান অধ্যয়ন করবেন।
লেসলি হোয়াইটের নৃবিজ্ঞান অধ্যয়ন শুরু হয় বোয়াসিয়ান স্কুলের হাত ধরেই।বোয়াসিয়ান স্কুলের মূল তাত্ত্বিক ফ্রাঞ্জ বোয়াস (franz Boas) বিবর্তনবাদের ঘোর বিরোধী ছিলেন। হোয়াইট মূলত বোয়াসের শিক্ষার্থীদের অধীনেই পড়াশোনা করেন এবং ডক্টরেট ডিগ্রি অর্জনের আগ পর্যন্ত বোয়াসিয়ান স্কুলের আলোকেই পড়াশোনা চালিয়ে যান। তিনি রবার্ট লুই এবং তাঁর কাজ `আদিম সমাজ` ( Primitive Society,1919) দ্বারাও অনেক প্রভাবিত ছিলেন। ১৯২৭ সালে লেসলি হোয়াইট বাফেলো বিশ্ববিদ্যালয়ে সমাজবিজ্ঞান ও নৃবিজ্ঞান বিভাগের ইন্সট্রাক্টর হিসেবে নিযুক্ত হন।
লেসলি হোয়াইট বোয়াসিয়ান স্কুলেও বেশিদিন স্থির থাকতে পারলেন না। বোয়াসের মতবাদকে বিশদভাবে ব্যাখ্যা করতে গিয়ে এবং ক্লাসরুমে লেকচার দেওয়ার সময় শিক্ষার্থীদের প্রশ্নোত্তর দিতে গিয়ে তাঁকে বেগ পেতে হয়। তিনি এই তত্ত্বের ফাঁকফোকর দেখতে পান। পরবর্তীতে তিনি বিবর্তনবাদের দিকে ঝুঁকে পড়েন। বাফেলো বিশ্ববিদ্যালয়ের ইন্সট্রাক্টর থাকাকালীন অবস্থায় সহকর্মী দর্শন বিভাগের অধ্যাপক মারভিন ফারবার (Marvin Farbar) এর দ্বারা প্রভাবিত হন।মারভিন হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে এবং বাইরেও কিছুদিন নৃবিজ্ঞান অধ্যয়ন করেন এবং তিনি বিবর্তনবাদ নিয়েও যথেষ্ট আগ্রহী ছিলেন।
লেসলি হোয়াইট বিবর্তনবাদ নিয়ে কাজ শুরু করেন। হোয়াইট এবং তাঁর শিক্ষার্থীরা সেনেকা রিজার্ভেশন এলাকার কাছাকাছি কাজ করছিলেন যা তাকে দ্রুতই মর্গানের ‘লীগ অব ইরাকোয়া’র ব্যাপার আগ্রহী করে তোলে। মজার ব্যাপার হলো, তখন থেকেই তিনি মর্গানের সব রচনা গভীরভাবে অধ্যয়ন করা শুরু করেন। যা তাঁকে একদম শুরুর দিকের বিবর্তনবাদী তাত্ত্বিকদের কাছাকাছি নিয়ে যায়। হোয়াইট শুধু মর্গানের জীবন ও কর্মের উপর নিবিড় অনুসন্ধান চালিয়েই কেবল ক্ষান্ত হন নি। মর্গান যে সব অঞ্চলে কাজ করেছেন তিনি সেখানেও সরেজমিনে গিয়েছেন, কাজ করেছেন।
আমেরিকান নৃবিজ্ঞানে বোয়াসিয়ান স্কুলের প্রভাবে যখন বিবর্তনবাদ মতবাদের অবস্থা একদমই নাজুক। সেখানে লেসলি হোয়াইট বিবর্তনবাদের সীমাবদ্ধতা কাটিয়ে তত্ত্বটির অবস্থান দৃঢ় করার চেষ্টা করেন। তাঁর একক এবং ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় বিবর্তনবাদ নতুন আঙ্গিকে অভির্ভূত হয় ‘নব্য-বিবর্তনবাদ’ নামে ।এটা নিয়ে কাজ করতে যেয়ে বোয়াসের অনুসারীদের সাথে বিতর্কেও জড়াতে হয়েছে তাঁকে ।
হোয়াইট-এর প্রদত্ত নব্য-বিবর্তনবাদী ব্যাখ্যা মূলত সাংস্কৃতিক বস্তুবাদ মূলক ব্যাখ্যা। তিনি এনার্জি ব্যয়ের দিক থেকে সমাজের বিবর্তনকে পরিমাপের সূচক হিসেবে একটি গ্রহনযোগ্য ও বিজ্ঞান সম্মত ব্যাখ্যা দেন যা ‘এনার্জি তত্ত্ব’ নামে খ্যাত। হোয়াইট ১৯২৯ সালে রাশিয়া এবং জর্জিয়া সফর করেন। সেখানে তিনি মার্ক্স এবং এঙ্গেলস কে নিয়ে পড়াশোনা করেন।সভ্যতার প্রকৃতি ও বিকাশ নিয়ে মার্ক্স এবং এঙ্গেলস যে আলোচনা করেছিলেন সেটাতেও আগ্রহী হন।
১৯৩০ সালে তিনি মিশিগান বিশ্ববিদ্যালয়ে জুলিয়ান স্টুয়ার্টের জায়গায় বদলি হোন। সেই সময় তিনি শিকাগো, ইয়েল ( Yele), কলম্বিয়া এবং হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে ভিজিটিং প্রফেসর হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৩৬ সালের শেষের দিকে পিকিংয়ের ইয়েনচিং ইন্সটিটিউটেও ভিজিটিং প্রফেসর হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ১৯২৬ সালের দিকে তিনি আমেরিকার দক্ষিণ-পশ্চিমে পাওলো ইন্ডিয়ানদের নিয়ে কাজ করেন। তাঁর কাজের ফলাফল হিসেবে অনেকগুলো মনোগ্রাফ রচিত হয়।
- The Acoma Indians (1932)
- The Pueblo of Sun felipe. (1932)
- The pueblo of San Doming, New Mexico. (1935)
- The pueblo of Santa Ana, New Mexico. (1942)
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় থেকে তিনি সংস্কৃতির-বিজ্ঞানের সীমারেখার উপর জোর দেন। Culture, Cultrology এবং Cultural Evolution নিয়ে তাঁর গুরুত্বপূর্ণ কাজ হলো- The Science of Culture (1949). ১৯৫৯ সালে তিনি সংস্কৃতির বিজ্ঞানের উপর রচনা করেন চার খন্ডের বিশাল গ্রন্থ- The Evolution of Culture(1959).
লেসলি হোয়াইট ১৯৭৫ সালে হঠাৎ করেই হার্ট অ্যাটাক করে পরলোক গমন করেন।
রেফারেন্স:
Knopf, A. Alfred. 1973. Leslie A. White (1900-75). Bohonnon, Poul and Glazer, Mark. High Points In Anthropology.( First edition. Page no:333-355). Purdue University, New York.
চৌধুরী, আ. ফ. হাসান। ২০০৩। নৃবৈজ্ঞানিক প্যারাডাইম (রূপান্তরের ধারা)। ইন্সটিটিউট অফ অ্যাপ্লাইড এ্যান্থ্রপলজি।লালমাটিয়া, ঢাকা।
https://biography.yourdictionary.com/leslie-a-white
https://www.britannica.com/biography/Leslie-A-White
…………………..
জিবান আহমদ
শিক্ষার্থী (অনার্স)
নৃবিজ্ঞান বিভাগ
শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়