Print Friendly, PDF & Email

সুমাত্রার রেইন ফরেস্ট অঞ্চলের শিকার-সংগ্রহকারী দল “ওরাং রিম্বা” (Orang Rimba)। ইন্দোনেশিয়ার বেশ কয়েকটি শিকার-সংগ্রহকারী দলের মধ্যে এরা অন্যতম। ইন্দোনেশিয়ান দ্বীপ সুমাত্রার জাম্বির ভেতর ও তার আশেপাশের রেইন ফরেস্ট অঞ্চলে প্রায় ৫০০০ জনের এই বিশেষ দলটির বসবাস। তাঁরা তাদের পূর্বপুরুষের বেশিরভাগ ভূমি থেকে বাস্তুচ্যুত হয়েছে। এই কোভিড -১৯ মহামারীর মধ্যেও এরা নিজেদের ঐতিহ্যবাহী প্রথাগুলো সংরক্ষণের চেষ্টা করছে। অসুস্থদের আলাদা করে দেওয়া এবং বাইরের লোকদের থেকে দূরে রাখা-এর মধ্যে অন্যতম। স্থানীয় ভাষায় এটি বেসস্যান্ডিংগন (besesandingon) নামে পরিচিত। এই প্রবন্ধে তাদের সামাজিক দূরত্বের এই কৌশলসহ এর পেছনের দর্শন নৃবৈজ্ঞানিক এ্যাপ্রোচ এর আলোকে বিস্তারিত তুলে ধরা হয়েছে।

………………………………………….

লিখেছেনঃ ডায়না রোচময়নিংসিংহ ও সুওয়ান্দি

অনুবাদ করেছেনঃ খলীলুল্লাহ মুহাম্মাদ বায়েজীদ, মো. রেদওয়ানুল ইসলাম, সুমাইয়া হাসিন ও আফরিন লাবনী।

২০২০ সালের মার্চ মাসের একটি নিঝুম রাত। ইন্দোনেশিয়ার জাম্বি (Jambi) এর বুকিট সুবান (Bukit Suban) নামক গ্রামের নির্জন পাম তেল বাগানে একজন নারীর উচ্চ কন্ঠে কান্নার আওয়াজ ছড়িয়ে পড়ে। আট সন্তানের জননী এই নারীর নাম ইন্দুক নাইরেউ (Induk Nyerau) । ঐতিহ্যবাহী কাঠের তাবুতে তীব্র জ্বর এবং শ্বাসকষ্টে কাতরাবস্থায় তিনি নত হয়ে আছেন।

তাঁর স্বামীর নাম মেরিয়াউ (Meriau)। তিনি জানান, একা হয়ে যাবার ভয়ে এবং দুঃখে ইন্দুক নাইরেউ (Induk Nyerau) সারারাত ধরে কেঁদেছিল। নাইরেউ কোভিড-১৯ এ আক্রান্ত এবং তাঁর দ্বারা গোটা গোষ্ঠী সংক্রমিত হবে- এই ভয়ে তাঁর সন্তান এবং আত্নীয় স্বজনরা তাকে নির্জন বাগানে রেখে চলে গিয়েছে। শুধুমাত্র তার স্বামী মেরিয়াউ (Meriau) দেখাশোনার জন্য রয়ে গেছেন। [যদিও] সে পাঁচ মিটার দুরত্বে অবস্থান করে তার [Induk Nyerau] দেখাশোনা করছে, কিন্তু কাছে যাবার সাহস পাচ্ছেনা।

মেরিয়াউ এবং ইন্দুক নাইরেউ ওরাং রিম্বা জাতিগোষ্ঠীর সদস্য। ইন্দোনেশিয়ার বেশ কয়েকটি শিকার-সংগ্রহকারী দলের একটি হলো এই ওরাং রিম্বা। ইন্দোনেশিয়ান দ্বীপ সুমাত্রার জাম্বির ভেতর ও তার আশেপাশের রেইন ফরেস্ট অঞ্চলে প্রায় ৫০০০ জনের এই বিশেষ দলটির বসবাস। এরা কোন রোগের ক্ষেত্রে বহু বছর ধরে চলে আসা ঐতিহ্যবাহী সামাজিক দূরত্বের কৌশল মেনে চলে, যা বেসস্যান্ডিংগন (besesandingon) নামে পরিচিত।

মেরিয়াউ ওরাং রিম্বা সম্পর্কে বলেন, “এই পৃথিবীতে রোগের প্রাদুর্ভাবকেই আমরা সবচেয়ে বেশি ভয় পাই।” স্থানীয় ভাষায় “রোগের প্রাদুর্ভাব”কে গেলাবাহ (Gelabah) বলা হয়। স্ত্রীর কোভিড -১৯ না হওয়ার খবর [লেখকদ্বয়কে] জানাতে পেরে তিনি খুব খুশি। তবে মেরিয়াউ জানান, তার স্ত্রীর আলসার হয়েছিল। তবুও, এই দম্পতি তাদের পরিবার দলে বা রোম্বংয়ে (rombong) যোগদানের আগে তার পুরোপুরি সুস্থতার জন্য অপেক্ষা করছিল।

মহামারীবিহীন স্বাভাবিক সময়েও প্রতিটি পরিবার দল বা রোম্বং বহিরাগতদের এবং ভ্রমণকরে বাড়ি ফেরা যে কোন ওরাং রিম্বা সদস্যকে সামাজিক মিথষ্ক্রিয়ার অনুমতি দেওয়ার আগে কমপক্ষে ১৫ মিটার দূরে অবস্থান করতে বলে। বেসস্যান্ডিংগনের অংশ হিসাবে, ওরাং রিম্বা সদস্যরা অসুস্থ লোকদের ত্যাগ করে (তারা যেমন ইন্দুক নাইরেউ-এর ক্ষেত্রে করেছিল), মৃতকে ছেড়ে চলে যায়। এবং শারীরিকভাবে দূরত্বে অবস্থান করা অসুস্থ ব্যক্তিদের কাছাকাছি ওষুধ রেখে দূর থেকে চিকিৎসা দেয় ।

বনধ্বংস ও প্রতিটি পরিবার দল বা রোম্বংয়ের স্থান সীমাবদ্ধ করার কারণে ওরাং রিম্বা জাতিগোষ্ঠীর জঙ্গলগুলো ক্রমশই হারিয়ে যাচ্ছে। এজন্য সাম্প্রতিক বছরগুলিতে বেসস্যান্ডিংগন বজায় রাখা আরও কঠিন হয়ে উঠেছে। সেমারাংয়ের ডিপোনগোরো বিশ্ববিদ্যালয়ের (Diponegoro University, Semarang) একজন নৃবিজ্ঞানী আদি প্রসেতিজো (Adi Prasetijo) বলেন “এটি একটি সাধারণ পরিস্থিতি।” তিনি প্রায় দুই দশকেরও বেশি সময় ধরে ওরাং রিম্বা জাতিগোষ্ঠী নিয়ে অধ্যয়ন করছেন।

রেইন ফরেস্টের বিনাশ এই দলটিকে বাস্তুচ্যুত করেছে এবং তাদের খাদ্য সরবরাহ সীমাবদ্ধ করেছে। এই প্রক্রিয়ার ফলে বাইরের সম্প্রদায়ের সাথেও তাদের বিরোধ বাড়ছে। প্রসেতিজো Indonesian Conservation Community’র সাথে কাজ করেন, যা KKI WARSI নামে পরিচিত। এটি এমন একটি বেসরকারী সংস্থা যা পরিবেশ সংরক্ষণের ক্ষেত্রে নৃবৈজ্ঞানিক অ্যাপ্রোচকে সর্বাধিক গুরুত্ব দেয়। সংস্থাটি ২ টি উপায়ে ওরাং রিম্বাদের উপর বনধ্বংসের প্রভাব হ্রাস করার চেষ্টা করছে। প্রথমত; ওরাং রিম্বাদের শিক্ষা এবং স্বাস্থ্যসেবায় প্রবেশাধিকার প্রদান এবং দ্বিতীয়ত; বৃক্ষরোপণের কাজে যুক্ত সংস্থাগুলির সাথে তাদের সৃষ্ট দ্বন্দ্বের মধ্যস্থতা করার মাধ্যমে। তবে প্রসেতিজো বলেন, সরকারের কোন ধরনের হস্তক্ষেপ ছাড়াই “ওরাং রিম্বা বর্তমানে সাংস্কৃতিক বিলুপ্তির দিকে চলছে।” এবং করোনাভাইরাস তাদের এই দুর্দশার মাত্রা আরো বাড়িয়ে দিয়েছে।

ওরাং রিম্বা জনগোষ্ঠী বহিরাগতদের সাথে যোগাযোগের ক্ষেত্রে গভীর বিরোধিতা করে। এই পরিহার বা বহিরাগতদের এড়িয়ে যাওয়ার কারণগুলো অনেক জটিল বলে নরওয়েজিয়ান নৃবিজ্ঞানী ওইভিন্দ স্যান্ডবুক্ট মনে করেন। তিনি জাম্বির ওরাং রিম্বাদের নিয়ে ১৯৭৯ ও ১৯৮০ সালে গবেষণা করে এই মতামত ব্যক্ত করেন।

স্যান্ডবুক্ট দেখান, ওরাং রিম্বা জনগোষ্ঠী বিশ্বকে দুটি পৃথক জগত হিসাবে দেখে। তাদের নামের অর্থ তাদের স্থানীয় ভাষায় “বনবাসী মানুষ”। তবে অন্য সবাইকে তারা বহিরাগত বা ওরাং টেরাং বা “উন্মুক্তস্থানের লোক” হিসাবে দেখে থাকে।

“উক্ত দুটি জগত সম্পর্কে তাদের বোঝাবুঝি… কেউ পরিবর্তন করতে পারবে না; এমনকি মরে গেলেও না,” এই [ওরাং রিম্বা] সম্প্রদায়ের বিষয়ে ১৯৪৮ সালে প্রকাশিত একটি প্রবন্ধে তিনি [নৃবিজ্ঞানী ওইভিন্দ স্যান্ডবুক্ট] লিখেছিলেন।

তবে স্যান্ডবুক্ট এখন ওরাং রিম্বা জনগোষ্ঠীর সাথে KKI WARSI’র কাজের পরামর্শদাতা হিসেবে যুক্ত রয়েছেন। তার ‍যুক্ততা অতি গুরুত্বপূর্ণ সময়েই হয়েছিল, বিশেষকরে যখন বাইরের বিশ্বের সাথে যোগাযোগ ও মিথষ্ক্রিয়া ওরাং রিম্বা জনগোষ্ঠীর জন্য অনিবার্য হয়ে উঠছিল। [স্যান্ডবুক্ট-এর যুক্ততার] পরবর্তী চার দশকে, সরকারী পলিসি বা নীতিমালা অনুযায়ী এ অঞ্চলে রাস্তাঘাট, ঘর-বাড়ি এবং একচেটিয়া পাম তেল চাষের জন্য পরিষ্কার করার অনুমোদন দেওয়ায় জাম্বির রেইন ফরেস্টের পরিমাণ ব্যাপকভাবে হ্রাস পাবে।

ওরাং রিম্বা জনগোষ্ঠী সকল ওরাং টেরাংকে মুসলিম মনে করে। [এখানে মুসলিম] এমন একটি বৈশিষ্ট্য যা তাদের দীর্ঘস্থায়ী প্রতিবেশীদের বিশ্বাসকে প্রতিফলিত করে। তবে জাভানিজ সম্প্রদায়ের অন্তর্ভুক্ত যারা সরকারের ট্রান্সমাইগ্রেশন প্রোগ্রামের অংশ হিসেবে জাম্বিতে এসেছিলেন- তারা, সানডবুক্ট এবং প্রসেটিজো-র মতো গবেষক ও কর্মীরা তাদের “বহিরাগত” শ্রেণীভূক্ত।

ওরাং রিম্বা জনগোষ্ঠী বিশ্বাস করে ওরাং টেরাং এবং তাদের সাথে সম্পর্কিত অন্যান্য যে কোন বস্তু [ওরাং রিম্বা গোষ্ঠীতে] রোগ ও মৃত্যু নিয়ে আসে। ফলে সকল বহিরাগতকে এরা এড়িয়ে চলে এবং সেখানে প্রবেশ নিষিদ্ধ। এরই প্রেক্ষিতে দশকের পর দশক ধরে স্যান্ডবুট, প্রসেতিজো এবং অন্যান্যরা রিম্বাদের সাথে যোগাযোগ করবার জন্য নৃবৈজ্ঞানিক এ্যাপ্রোচের প্রয়োগ করে আসছেন। ফলে গোষ্ঠীতে কর্মরত KKI WARSI’র সদস্য বা স্টাফগণ এখন সেখানে এক সপ্তাহ, এমনকি মাসও অবস্থান করে নানাবিধ বিষয়ে জানতে পারেন। কোন রম্বং [ওরাং রিম্বা পরিবার দল] তাদের কাছাকাছি আসার অনুমতি না দেয়া পর্যন্ত তারা [KKI WARSI’র কর্মী বা সদস্য] সামাজিক দূরত্বও পালন করে।

এই [নৃবৈজ্ঞানিক] এ্যাপ্রোচটি বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ অন্তর্দৃষ্টি হাজির করেছে। প্রসেতিজো তাঁর নিজ মাঠকর্মে জাম্বি এলাকার অধিবাসীদের মধ্যে একে অপরকে দেখার দৃষ্টিভঙ্গিতে আকর্ষণীয় বৈপরীত্য দেখতে পান। উদাহরণস্বরূপ প্রসেতিজো মালয় গ্রামবাসি ওরাং রিম্বা জনগোষ্ঠীকে যেভাবে দেখে থাকে তা ব্যাখ্যা করেন। তিনি বলেন- তারা [মালয় গ্রামবাসি] “নিজেদেরকে [ওরাং রিম্বা জনগোষ্ঠী থেকে] শ্রেষ্ঠতর মনে করে।” ওরাং রিম্বা জনগোষ্ঠীর বসবাসের জন্য নিজ ভূমি তথা বন থেকে আবাদি জমিতে স্থানান্তরিত হতে না চাওয়াকে “একগুঁয়ে মনোভাব” হিসেবে দেখে ।

তবে প্রসেতিজো গবেষণা করে আরো জানতে পারেন, ওরাং রিম্বা তাদের পূর্বপুরুষদের প্রতি শ্রদ্ধার কারণে নিজেদের বসতভিটার সাথে বিশেষ ধরণের টান বা আকর্ষণ অনুভব করে। একারণে তারা তাদের পরিবারের জন্য নির্দিষ্ট জায়গা নির্ধারনে বিশ্বাস করে। “যদি কোনো দলের জন্য মনোনীত জায়গা পাম তেল বাগানে পরিণত হয় তাহলে তারা আর বনে ফিরে যেতে পারবে না কারণ এটি অন্য রম্বং [পরিবার দল] এর অধিনস্ত হয়ে যাবে।”- প্রসেতিজো ব্যাখ্যা করেন।

ইন্দোনেশিয়াতে ওরাং রিম্বা জনগোষ্ঠীর সাথে অন্যান্যদের ক্ষমতার সম্পর্ক বুঝতে এই সব সাংস্কৃতিক পর্যবেক্ষণ KKI WARSI কে সাহায্য করেছে। ২০০০ সালে দলটি (KKI WARSI) বুকিট ডুয়াব্লাস জাতীয় উদ্যান (Bukit Duabelas National Park) গড়ে তোলার জন্য বনের ৬০,৫০০ হেক্টর জমি মঞ্জুর করতে ইন্দোনেশিয়ান সরকারকে বোঝাতে সফল হয়। জমিটি [ওরাং] রিম্বাদের জন্য বিশেষভাবে মনোনীত করা হয়। (এই সাফল্য রিম্বাদের জন্য ছিলো তাৎপর্যপূর্ণ। তারা ১৬ বছর ধরে উদ্যানটিকে ব্যবহার করে আসছে।)

ওরাং রিম্বার ন্যায় ক্ষুদ্র সম্প্রদায়ের জন্য “একটি সুবিশাল বাসস্থান প্রয়োজন”- এই বিষয়টি “জনগোষ্ঠীটির গভীর নৃবৈজ্ঞানিক অধ্যয়ন” ছাড়া সরকারকে বোঝানো সম্ভব হত না বলে KKI WARSI তে কর্মরত নৃবিজ্ঞানী রবার্ট এ্যারিটোনাং (Robert Aritonang) স্পষ্ট করেন।

ওরাং রিম্বা সম্পর্কিত KKI WARSI’র প্রতিবেদনে তাদের সাথে সংস্থাটির প্রথম দিকের যোগাযোগের প্রসঙ্গগুলোও উঠে এসেছে। প্রসেতিজো বলেন, “আমরা যারা ওরাং রিম্বা শিশুদের পড়ালেখা শেখাতে চেয়েছিলাম, প্রথম ‌দিকে তারা [ওরাং রিম্বা দল] আমাদেরকে প্রত্যাখান করেছিল।” তিনি আরো বলেন, “তারা ভেবেছিলো বই এবং পেন্সিল রোগ নিয়ে আসে।” তবে ওরাং রিম্বা জনগোষ্ঠীর বিশ্ব দর্শনের আলোকে KKI WARSI’র কর্মীরা আরো আলাপচারিতার পূর্বে বেশ কয়েকদিন রম্বংয়ের ঐতিহ্যবাহী কাঠের তাবুতে অপেক্ষা শুরু করে, যা [বাইরের মানুষ সম্পর্কে রিম্বা] জনগোষ্ঠীর ভয়কে প্রশমিত করতে সাহায্য করে।

ওরাং রিম্বাদের জন্য ঔষধ এবং ভ্যাক্সিন/টিকা সরবরাহের ক্ষেত্রে দলটির মেডিকেল ইন্টারভেনশনেও একই ধরনের আ্যপ্রোচ ব্যাবহার করা হয়। কিন্তু করোনা ভাইরাস নতুন প্রতিবন্ধকতা তৈরি করেছে। মহামারি সচেতনতায় রিম্বা জনগোষ্ঠী KKI WARSI সদস্যসহ অন্যান্য যে কোন বহিরাগতদের তুলনায় আরো অধিক সতর্ক।

কেকেআই ওয়ারসি (KKI WARSI)’র স্বাস্থ্য সহায়তাকারী মারিয়া ক্রিস্টিনা নোরাড স্মরণ করে বলেন, মহামারিরর শুরুতে “তাদের (রিম্বা) কয়েকজন বলেছিলো যদি তাদের এলাকাতে কোন বহিরাগত প্রবেশ করে তাহলে তাকে গুলি করবে।” তবুও নোরাডকে শিশুদের টিকাদান, নারীদের গর্ভকালীন চেকআপের মতো প্রাথমিক স্বাস্থ্য চিকিৎসা সরবরাহ করার জন্য গৌষ্ঠীগুলোতে পৌছানোর দরকার ছিলো। নিজেকে প্রস্তুত করতে তিনি [নোরাড] ১৪ দিনের আইসোলেশনে থাকেন এবং মাঠে যাবার পূর্বে কোভিড-১৯ এর ডায়াগনস্টিক টেস্টও করেন। এরপরও কিছু গোষ্ঠী তার উপস্থিতির অনুমোদনের আগে নোরাডকে কয়েক সপ্তাহ পায়ে হেঁটে ভ্রমণ এবং বিভিন্ন রম্বংয়ে যেতে হয়েছিল।

ইতোমধ্যে, অনেকগুলো রম্বং অসুস্থ ব্যক্তিদের আলাদা করার জন্য পরিবারের নির্ধারিত জায়গাগুলো ব্যবহার করা শুরু করেছে – এমনকি এই জায়গাগুলি বুকিট ডুয়াব্লিস জাতীয় উদ্যানের সীমানার বাইরে অবস্থিত। এর মধ্যকার কিছু স্থান বিপজ্জনক; যেমন – পাম তেল বাগানের মত জায়গা যেখানে মেরিয়াউ তার অসুস্থ স্ত্রীর সাথে ছিলেন। ওই জায়গায় খাদ্য ও বিশুদ্ধ পানির অভাব রয়েছে। এবং একটি বৃক্ষরোপণ এলাকায় অবস্থিত হওয়ায় এখানে বাইরের লোকদের যাতায়াত রয়েছে। যার ফলে এই রোগ বহন করতে পারে এমন বহিরাগতদের সংস্পর্শে ওরাং রিম্বা সদস্যদের যাওয়ার ঝুঁকি আরো বৃদ্ধি পায়। তা সত্ত্বেও, সেপ্টেম্বর মাসে ইন্দুক নায়রাউ তার নবম সন্তান প্রসবের জন্য এই জায়গাতেই ফিরে আসেন।

বেসস্যান্ডিংগন পদ্ধতির ক্ষেত্রে দূরত্ব বজায় রাখার গুরুত্ব সম্পর্কিত ওরাং রিম্বা জনগোষ্ঠীর বিশ্বাস তাদের পূর্বপুরুষদের দ্বারা নির্ধারিত হয়েছে। তাই বহিরাগত কারো পক্ষে এর সংস্কার সাধন করা সহজ নয়। ওরাং রিম্বা অধিবাসীদের জন্য সরকারী উদ্যোগে অস্থায়ী আবাসন তৈরির প্রচেষ্টা এর প্রকৃষ্ট উদাহরণ।

ওরাং রিম্বা অধিবাসিরা এধরনের মহামারীর প্রতিরোধে সময় এবং দূরত্ব বজায় রাখাকে কাজে লাগায়। এই অঞ্চলের মহিলা এবং শিশুরা মেলাঙ্গুন পদ্ধতির সাথে অভ্যস্থ্, এটি এক ধরনের শোক ব্যবস্থা এবং যখন কেউ মারা যায় তখন অন্যরা সেই স্থান থেকে দূরে সরে যায়।

কিন্তু অ্যারিটোনাং যুক্তি উত্থাপন করে বলেন, এই ধরনের কর্মকান্ডগুলো শুধুমাত্র band-aids যা গভীর অরণ্যে বসবাসকারী জনগোষ্ঠীর মূল রোগের ক্ষেত্রে এরূপ হতে পারে। কে.কে.আই ওয়ার্সির মতে, ২০১৮ সালে জাম্বিতে ৫,২৩৫ জন ওরাং রিম্বা জনগোষ্ঠীর বসবাস ছিল। তাদের মধ্যে মাত্র ৪০ শতাংশ লোক এখনো পর্যন্ত বনে বসবাস করে এবং বাকিরা দেশটির জাতীয় উদ্যান পার্কের বহির্ভাগে সরকারের নির্মিত অস্থায়ী বসতিতে বা ট্রান্স-সুমাত্রা মহাসড়কের পাশে বসবাস করে।

প্রসেতিজো ব্যাখ্যা করে বলেন, এদের মধ্যে অনেকে পথের ধারে ভিক্ষা-বৃত্তিতে জড়িয়ে পড়েছে এবং অনেকে তেল, পাম ফল সংগ্রহ ও বিক্রি করে জীবিকা নির্বাহ করছে। এদের কাজকর্মে “সংস্থাগুলি ক্ষুব্ধ হয়ে তাদের চোর বলে ডাকে। তিনি ব্যাখ্যা করে আরো বলেন, সরকার কেন তাদের জমি অধিগ্রহণ করেছে সে বিষয়ে তাদের সম্মক ধারনা নেই। তারা শুধু তাদের বসতি, জীবিকা নির্বাহের ভূমি ফিরে পেতে আগ্রহী।

প্রসেতিজো বলেন, ১৯৯৭ এবং ২০১৮ এর মধ্যে ওরাং রিম্বা এবং অন্যদের নিয়ে কমপক্ষে ১৫টি দ্বন্দ্ব-সংঘাতের ঘটনা নথিভূক্ত রয়েছে। যে ঘটনায় কমপক্ষে ১৭ জন ওরাং রিম্বা মারা গিয়েছিল। তিনি এবং অ্যারিটোনাং বিশ্বাস করেন যে, এই সমস্যাগুলির অন্তর্নিহিত সমাধান ইন্দোনেশিয়ার সরকারের হাতে রয়েছে। সরকার তাদেরকে গৃহ ও জীবিকা নির্বাহের জন্য তাদের হারিয়ে যাওয়া জমি ফিরিয়ে দিয়ে উক্ত সমস্যার সমাধানে হস্তক্ষেপ করতে পারে। এই ধরনের পরিবর্তনের জন্য সরকারের আইনি সংস্কারের ক্ষেত্রে কাজ করা প্রয়োজন। কে.কে.আই ওয়ার্সি এর নৃবিজ্ঞানীরা মত দেন, ওরাং রিম্বাকে শুধুমাত্র তাদের হারানো বসবাসের স্থানই নয় বরং এটি তাদের তাৎপর্যপূর্ণ আধ্যাত্নিক সীমানা যা তাদেরকে জীবিকা প্রদান করে যা ফিরিয়ে দিলে অন্য যেকোন কিছুর চেয়ে তাদের ক্ষতিপূরণে কম ব্যর্থ হবে।

একইভাবে, তারা বিশ্বাস করেন যে করোনাভাইরাসের প্রতিক্রিয়ার ক্ষেত্রে আরো অনেক বেশি সাংস্কৃতিক ভিত্তি প্রয়োজন। নভেম্বরের দিকে ইন্দোনেশিয়ার সরকারের সামাজিক বিষয়ক মন্ত্রনালয় স্থানীয় এনজিও এর সাথে সমন্বয় করে নয়টি রিম্বাকে ভিটামিন, হ্যান্ড স্যানিটাইজার এবং মাস্ক সরবরাহের মাধ্যমে সহযোগিতা করেছিল। এমনকি কর্মকর্তারা নগদ অর্থ সহায়তারও প্রস্তাব দিয়েছিলেন।

কিন্তু এই সম্প্রদায়ে মহামারী ছড়িয়ে পড়ার প্রতিরোধে সরকারের প্রচেষ্টাে একধিক দিক থেকে সীমাবদ্ধ হয়ে গিয়েছিল- ওরাং রিম্বাদের জীবনযাত্রার অবস্থা অনুযায়ী কতটা নিরাপত্তা সামগ্রী দেওয়া প্রয়োজন তা সনাক্ত করতে সরকার ব্যর্থ হয়েছে। নির্ভরযোগ্য পরিস্কার পানির পর্যাপ্ততা এবং নিরাপদ আশ্রয়স্থল ছাড়া বনের মধ্যে প্রতিরোধ ব্যবস্থা সরবরাহ করা যায় না। এছাড়া নির্দেশনা যেমন ঘন ঘন হাত ধোয় অথবা মাস্ক পরিস্কার করা যা এই সম্প্রদায়ের জন্য অনুসরন করা কঠিন।

The National Geographic Society COVID-19 Emergency Fund for Journalists এই নিবন্ধ তৈরিতে সহায়তা করেছে।

*ডায়না রোচময়নিংসিংহ, ইন্দোনেশিয়ার উত্তর সুমাত্রায় অবস্থিত একজন মুক্তমনা বিজ্ঞান সাংবাদিক।

*সুয়ান্দি, ইন্দোনেশিয়ার জাম্বি’র একজন সাংবাদিক।

মূল লেখার লিংক: https://www.sapiens.org/culture/orang-rimba-covid-19/

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here