নারীকে একজন স্বতন্ত্র ব্যক্তি হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়ার জন্য যুগে যুগে যারা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছেন তাদের মধ্য থেকে সেরা ১০ জন নারীবাদীর কাজ নিয়ে গার্ডিয়ান পত্রিকা একটি প্রবন্ধ প্রকাশ করেছে। মূলত ‘নারীবাদ’ প্রসঙ্গটি একদিনে সমাজে বিস্তার ঘটেনি। নারীদের নানা অধিকারের ইস্যু নিয়ে একেক ধাপে একেক দাবীর ভিত্তিতে এই সম্পূর্ণ কনসেপ্ট দাঁড়িয়েছে। ১০টি সেরা নারীবাদী গ্রন্থের সারাংশ প্রকাশ করা হলো। লিখাটি অনুবাদ করেছেন- খলিলুল্লাহ মুহাম্মাদ বায়েজীদ।
১. সিমোন দ্য বোভোয়ার এর দ্যা সেকেন্ড সেক্স (১৯৪৯) [The Second Sex by Simone de Beauvoir (1949)]
দি অবজার্ভার এর ১০ টি সেরা নারীবাদী গ্রন্থের প্রথমটি সিমোন দ্য বোভোয়ারের দ্যা সেকেন্ড সেক্স (১৯৪৯)। আমাদের বাংলা ভাষায় বইটি দ্বিতীয় লিঙ্গ (২০০১) শিরোনামে অনুবাদ করেছিলেন কবি, ঔপন্যাসিক, গল্পকার, গবেষক ও ভাষাবিজ্ঞানী হুমায়ূন আজাদ। বোভোয়ারের পুরো নাম সিমন লুসি এর্নেস্তিন মারি বেরত্রঁ দ্য বোভোয়ার (ফরাসি: Simone Lucie Ernestine Marie Bertrand de Beauvoir)। তবে তিনি সিমন দ্য বোভোয়ার নামেই বেশি পরিচিত ছিলেন। তিনি একাধারে একজন ফরাসি লেখিকা, বুদ্ধিজীবী, অস্তিত্ববাদী দার্শনিক, রাজনৈতিক-কর্মী, নারীবাদী ও সমাজতত্ত্ববিদ হিসেবে বিবেচিত। এ বইটিতে বোয়েভার লৈঙ্গিক রাজনীতিকে বিশ্বের সামনে পরিচিত করেছেন।
এ বইয়ের মাধ্যমে যৌনতা, চাকরি বা পেশা এবং পরিবার থেকে পতিতাবৃত্তি, গর্ভপাত এবং নারী পরাধীনতার ইতিহাস সম্পর্কিত বিষয়গুলি অন্বেষণ করে বোভোয়ার পুরুষদের “আদর্শ” এবং মহিলাদের “অন্য” হিসাবে বিবেচনা করা পরিবেশন ও মনে করার ধারণাকে চ্যালেঞ্জ জানিয়েছেন। এই বইতে সিমোন দ্যা বুভোয়ার স্পষ্টভাবে উচ্চারণ করেন- “কেউ নারী হিসেবে জন্মায় না, সমাজ তাকে পরিণত করে নারীতে” বা “কেউ নারী হয়ে জন্মায় না, বরং সমাজই একজন মানুষকে নারী বানায়।” তবে অনুবাদ অনুসারে তাঁর এ উদ্ধৃতিটির শব্দচয়নে ভিন্ন ভিন্ন হয়ে থাকে।
“নারী কে?”- বুভোয়ার তার এ বইতে এই প্রশ্ন এবং যুক্তি দিয়ে উত্তর দিয়েছেন। তিনি বলেন, পুরুষরা নারীদের আত্মপরিচয়কে অস্বীকার করে নিজেদের অতিরিক্ত অংশ মনে করে; এমনকি ‘মনুষ্যত্ব’ বলতে শুধু পুরুষকেই বোঝান হয়। নারীদের নিয়ে বেশ কয়েকজন প্রখ্যাত লেখকের মতামতকে চ্যালেঞ্জ জানিয়ে তিনি বাতিল করে দেন। এখানে তিনি কীভাবে এঙ্গেলস এর নারীর অধীনতা সম্পর্কিত ধ্যানধারণাকে খারিজ করে দেন- তা উদাহরণ টানা যায়।
প্রখ্যাত সমাজতত্ত্ববিদ ফ্রেডরিখ এঙ্গেলস তাঁর The Origin of Family, Private Property and the State (1884) বইতে নারীর অধীনতা প্রসঙ্গে ব্রোঞ্জ যুগে ব্যক্তিগত সম্পত্তির ধারণার কথা বলেন। বুভোয়ার বিভিন্ন পুরাণ থেকে ব্যাখ্যা গ্রহণ করে দ্ব্যর্থহীনভাবে খারিজ করে দেন। তার মতে, উৎপাদনকার্যে অংশগ্রহণ এবং জন্মদানের দাসত্ব থেকে স্বাধীনতার মাধ্যমে নারীর অবস্থার পরিবর্তন করা যায়।
বলা হয়, লিঙ্গীয় রাজনীতিতে এ বইটির প্রভাব জানতে চাওয়া আর পৃথিবীর জন্য সূর্যের ভূমিকা ভেবে/চিন্তা করে বিস্মিত হওয়া সমান। তাহলে, প্রশ্ন আসে সূর্য পৃথিবীর জন্য কী করেছে? উত্তর হলো- সবকিছু। তেমনিভাবে লিঙ্গীয় রাজনীতি বোঝাবুঝিতে এ বইয়ের ভূমিকাও সমান। আজও দ্য সেকেন্ড সেক্স বইটি নারীবাদী দর্শনের ভিত্তি হিসেবে প্রশংসিত। অনেকের কাছে দ্য সেকেন্ড সেক্স কেবল প্রধান নারীবাদী পাঠই নয়, বরং নারীবাদী চিন্তাধারা এবং অস্তিত্বকেই উপস্থাপন করে।
উল্লেখ্য বাংলায় হুমায়ূন আজাদ অনুদিত উক্ত বইটি ২০০১ সালে প্রথম প্রকাশ করে ঢাকার আগামী প্রকাশনী।
২. বেটি ফ্রাইডেনের দ্যা ফেমিনাইন মিস্টিক (১৯৬৩) [The Feminine Mystique by Betty Friedan (1963)]
দ্যা ফেমিনাইন মিস্টিক নারীবাদী বেটি ফ্রাইডেনের একটি যুগান্তকারী বই। এটি ১৯৬৩ সালে প্রকাশিত হয়। এ বইতে বেটি ফ্রাইডেন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী সময়ে মূলধারার আমেরিকান সমাজে মহিলাদের মধ্যে গভীর অসন্তুষ্টি বর্ণনা করে সে সময়ের শিক্ষিত নারীর অসন্তোষ ও স্বপ্নভঙ্গ সম্পর্কে নিজের বক্তব্য উপস্থাপন করেন। তবে এটি কেবলি বর্ণনা ছিল না, এটি ছিল পুরুষতন্ত্রের বিরুদ্ধে অস্ত্র হাতে তুলে নেওয়ার ডাক/আহবান। তার এই ডাকই বিশ্বজুড়ে সাধারণ নারীদের কাছে “নারীবাদের দ্বিতীয় তরঙ্গ” হিসাবে পরিচিত হয়ে ওঠে ও নারীবাদী আন্দোলনকে এক অন্যরকম গতি প্রদান করে।
প্রশ্ন ওঠে ফেমিনাইন মিস্টিক প্রত্য়য়টি দ্বারা কি বুঝিয়েছেন? মূলত; গৃহকর্ম, বিবাহ, যৌন নিষ্ক্রিয়তা (sexual passivity) এবং একা একাই সন্তান লালন-পালনের মাধ্যমে মহিলারা পূর্ণাঙ্গতা অর্জন করতে পারেন- এমন সামাজিক ধ্যান-ধারণাকে বর্ণনা করার জন্য তিনি এই ফেমিনাইন মিস্টিক বা “মেয়েলি রহস্য” বা “নারীত্বের রহস্য” প্রত্যয়টির উদ্ভাবন করেন। ফ্রাইডান নারীদের জীবনে পরিপূর্ণতার অভাবের তদন্ত করে “যে সমস্যাটির কোনও নাম নেই” তাও চিহ্নিত করেছিলেন। তিনি দেখান, “গার্হস্থ্য” এবং “তুচ্ছ” সবকিছুই নারীদের বিষয় হিসাবে বিবেচিত হত এবং বিপরীতে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলি “কেবলই পুরুষদের জন্য” চিহ্নিত ছিল। তদুপরি, প্রচলিত মনোভাব তৎকালীন আমেরিকান সমাজে প্রভাবশীল ছিল যে, “সত্যিকারের নারীরা” উচ্চশিক্ষা, কর্মজীবন বা রাজনৈতিক কণ্ঠের প্রতি আগ্রহী নয়; বরং তারা ঘরোয়া ক্ষেত্রে সম্পূর্ণ পরিপূর্ণতা পেয়েছে। নারীদের শরীরই তাদের নিয়তি- দ্য ফেমিনাইন মিস্টিক এই ধারণাকে চ্যালেঞ্জ করে। এ ধরনের ধারণাকে নারীদের জন্য একটি স্পষ্টত অবজ্ঞা হিসেবে তুলে ধরেন, যা কিনা আজও বিভিন্ন সমাজে প্রতিধ্বনিত হচ্ছে। তার মতে, নারীরা এমন একটি ভ্রান্ত বিশ্বাস ও ব্যবস্থার শিকার হয়েছে, যা নারীদের তাদের খোদ নিজ স্বামী ও সন্তানের মধ্যেই নিজেদের পরিচয় ও জীবনের অর্থ খুঁজতে বাধ্য করে। যার ফলে নারীদের আত্মপরিচিতি বলে তার কিছু থাকে না। তৎকালীন দ্বিতীয় বিশ্ব যুদ্ধোত্তর সমাজে নারীর অবস্থান সম্পর্কিত বেটি ফ্রাইডেনের এই নতুন এই ব্যাখ্যা নারীমুক্তি আন্দোলনের পথ দেখিয়েছিল।
৩. কেইট মিলেট এর সেক্সুয়াল পলিটিক্স (১৯৭০) [Sexual Politics – Kate Millett, 1970]
১০ টি সেরা নারীবাদী গ্রন্থের তৃতীয়টির শিরোনাম সেক্সুয়াল পলিটিক্স (১৯৭০)। বইটি লিখেছেন কেট মিলেট। তার পুরো নাম ক্যাথরিন মারে মিলেট। মিলেট একাধারে একজন আমেরিকান নারীবাদী, লেখক এবং শিল্পী, একজন প্রাথমিক ও নারী মুক্তি আন্দোলনের একজন প্রভাবশালী ব্যক্তিত্ব। তাঁর পিএইডি অভিসন্দর্ভ হিসেবে এই বই তৈরি করেছিলেন। বইটিতে যৌন রাজনীতি, লিঙ্গ এবং যৌনতার সাথে সম্পর্কিত ক্ষমতার গতিশীলতার অনুসন্ধান শুরু করা হয়েছে।
তিনি সাহিত্য ও জন সংস্কৃতিতে কীভাবে নারী চরিত্রের উপস্থাপনা নিয়মিতভাবে হ্রাস পেয়েছে এবং যেভাবে নারীদের যৌনবস্তু হিসেবে চিত্রায়িত করা হয়েছে- তা তুলে ধরেছেন। তার মতে, এভাবে নারীদের পরিবেশন মানুষ হিসেবে তাদের অবস্থানকে খাটো করে। বড় বড় সাহিত্য ও শিল্পে নারীদের পরাধীনতার বিষয়টি তিনি অনুসন্ধান করেন। ডি.এইচ. লরেন্স, হেনরী মিলার, নরমান মেইলার ও জিন জেনেট প্রমুখদের কাজগুলো অধ্যয়ন করে এদর লেখালেখিগুলোকে পিতৃতান্ত্রিক ও পুরুষ প্রভাবশালী লিঙ্গীয় পক্ষপাতদুষ্ট বলে আখ্যা দেন। এ এজন্য ডি.এইচ. লরেন্স, হেনরী মিলার ও নরমান মেইলার ও জিন জেনেট প্রমুখ সাহিত্যিকদের তিনি পিতৃতান্ত্রিক ও পুরুষ প্রভাবশালী লিঙ্গীয় পক্ষপাতদুষ্ট বলে আখ্যা দেন। তার মতে, এ সব সাহিত্যিক পিতৃতান্ত্রিক কল্পকাহিনীর মাধ্যমে মনোবিজ্ঞান, দর্শন এবং রাজনীতিতে এক বিশাল ও ক্ষতিকারক সাহিত্য ভাণ্ডার তৈরি করেছে। এজন্য সাহিত্যতত্ত্বের ইতিহাসে কেট মিলেটের এই বইটিকে প্রথম বই হিসেবে চিহ্নিত করা যায় যেখানে নারীবাদী দৃষ্টিকোণ থেকে পুরুষ লেখকদের একাধিক বইয়ের পুঙ্খানুপুঙ্খ বিশ্লেষণ করে দেখানো হয়েছে যে কীভাবে তারা নারী চরিত্রকে “একটি যৌনবস্তু মাত্র” হিসেবে পরিবেশন করেছে।
এ বইটি পাঠকদের কেবলমাত্র উদ্ধৃত বিষয়গুলো নিয়েই প্রশ্ন করতে উত্সাহিত করেনি, বরং আমাদের চারপাশের সমস্ত কিছু এবং কীভাবে যৌনতাবাদ পদ্ধতিগতভাবে গ্রোথিত- তা সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিকভাবে আরও ভালভাবে বোঝা যায়। এজন্য তার বইটি আজও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণভাবে প্রাসঙ্গিক।
৪. জার্মেইন গ্রেয়ার এর দ্যা ফিমেল ইউনাক (১৯৭০) [The Female Eunuch by Germaine Greer (1970)]
জার্মেইন গ্রেয়ার লন্ডনে বসবাসরত একজন অস্ট্রেলিয়ান একাডেমিক এবং সাংবাদিক। তিনি ১৯৭০ সালে তার বই দ্যা ফিমেল ইউনাক প্রকাশ করেছিলেন। এ বইটি গ্রাউন্ড ব্রেকিং, বিশ্বব্যাপী বেস্ট সেলিং ও একটি নারীবাদী ক্লাসিক হিসেবে স্বীকৃত। বইতে তিনি যুক্তি দিয়েছিলেন যে, নারীদের প্রতি যৌন নিপীড়ন/নির্যাতন তাদেরকে সৃজনশীল শক্তি থেকে দূরে সরিয়ে দেয়- যা কিনা তাদের স্বাধীন ও স্ব-পরিপূর্ণ হওয়ার প্রয়োজন।
১৯৭০ জার্মেইন গ্রেয়ারের এ বইটির প্রকাশনা একটি যুগান্তকারী ঘটনা ছিল। যৌন মুক্তিই নারীর মুক্তির চাবিকাঠি-তার প্রধান যুক্তি। বইটির প্রচ্ছদে উত্তেজক নারী দেহ দ্বারা বইয়ের মেজাজ আবহ তৈরি হয়েছে, আর মূলপাঠ নারীদের একচেটিয়া বিবাহসহ পুরুষ নির্ধারিত লিঙ্গীয় “স্বাভাবিকতা” থেকে সমস্ত উপায়ে মুক্ত হতে পরামর্শ দেয়। তবে সাংবাদিক ও সংগঠক রোজি বয়কট (Rosie Boycott) মনে করেন, মহিলা নপুংসক প্রভাবটি কেবল প্রকাশিত হওয়ার সময়ে স্থাপন করেই পরিপূর্ণভাবে উপলব্ধি করা সম্ভব। ১৯৭০ সালে, মহিলারা কোনও বন্ধক পেতো না, এমনকি গাড়ি কিনতেও পারত না, যদি না তাদের স্বামী বা বাবা নথিগুলিতে দস্তখত বা সাইন না করতো। নারীদের জন্য ক্ষেত্রগুলো সঙ্কুচিত ছিল। জারমাইন এই ঘোরের এবং ঘূর্ণিঝড়ের মতো সীমাবদ্ধ জীবনের বিরুদ্ধে চ্যালেঞ্জ জানান। তিনি বলেছিলেন, আপনার সামাজিক অবস্থার বাইরে চিন্তা করুন। তিনি বিবাহের স্বীকৃত ধারণাগুলি, অনু পরিবার এবং বংশবৃদ্ধির বাধ্যবাধকতাকে চ্যালেঞ্জ জানিয়েছিলেন। এবং এগুলেঅর পরিবর্তে চিকিৎসক, আইনজীবী এবং ব্যবসায়ী নারী হওয়ার পরামর্শ দিয়েছিলেন।
জার্মেইন গ্রেয়ারকে গৃহদাহী নারীবাদী হিসেবেও চিহ্নিত করেন দ্যা নিউ স্টেইটমেন্ট পত্রিকার ডেপুটি এডিটর হেলেন লুইস (Helen Lewis)। তার মতে, আন্ড্রেয়া ডওয়ারকিন (Andrea Dworkin) বা কিম্বারেল ক্রেনশোর ( Kimberlé Crenshaw) মতো তিনি কোনও নির্দিষ্ট বিষয় বা তত্ত্ব নিয়ে তিনি সর্বদা যুক্ত ছিলেন না। বরং তিনি নারীবাদকে একটি ধ্বংসাত্মক শক্তি হিসাবে, স্টেরিওটাইপস ছিঁড়ে ফেলা এবং নিষিদ্ধ ট্যাবুগুলিকে ধ্বংস কারী হিসেবে দেখেছেন।
দ্যা ফিমেল ইউনাক বইটি একটি নারীবাদী ক্লাসিক হিসাবে রয়ে গেছে এবং সত্যিকার অর্থে তার সময়ের একটি অন্যতম সেরা বই ছিল। এমনকি এ বইতে তিনি, মহিলাদের তাদের মাসিক/তুস্রাবের রক্তের স্বাদ নেওয়ার পরামর্শ দেওয়া হয়েছিল। ১৯৭০ সালে লেখা হলেও এ বইটার আবেদন ও প্রাসঙ্গিকতা এখনো অত্যধিক।
৫. সুসান ব্রউনমিলার এর এগেইনস্ট আওয়ার উইল: মেন, ওমেন এ্যান্ড রেইপ (১৯৭৫) [Against Our Will: Men, Women and Rape by Susan Brownmiller (1975)]
ধর্ষণের মতো সহিংসতার শিকার মানুষজনকে নিয়ে জনপরিসরে বিভিন্ন ধরণের মন্তব্য-কথাবার্তা বলতে দেখা যায়। এ ধরণের কথাবার্তার মাঝে কেন্দ্রীয় জায়গা দখল করে রয়েছে- ‘খোদ ভিক্টিমকে দোষ’ দেয়ার বিষয়টি’। এর বাইওে এমন কিছু মানুষ রয়েছেন যারা এ ধরনের পাশবিক সহিংসতার শিকার মানুষদেও নিয়ে চিন্তা করেন- তাদেরকে সমাজ ও সমাজস্থ মানুষ কীভাবে দেখে, কোন ধরনের মানষিক ও সামাজিক চ্যালেঞ্জের মধ্য দিয়ে যেতে হয় সে সব বিষয় নিয়ে। যদিও এ সংখ্যাটা খুবই নগণ্য। আর বর্তমানে যারা এসব বিষয়ে ভাবেন তাদের জন্য Susan Brownmiller এর Against Our Will: Men, Women and Rape (১৯৭৫) বইটি গুরুত্বপূর্ণ।
ব্রউনমিলার এ বইতে ধর্ষণকে শাস্তিযোগ্য অপরাধ হিসেবে চিহ্নিত করেছেন। তার ভাষায়, ধর্ষণ [শুধুমাত্র] ব্যক্তির লালসা পূরণ নয়; বরং [এটি এক ধরনের] সহিংসতা ও ক্ষমতা’। এ সহিংসতার শিকার মানুষজনকে ‘এটি তাদের প্রাপ্য ছিল’ কিংবা ‘ভিক্টিমকেই দোষ দেয়া সংস্কৃতির’ মতো প্রতারণাপূর্ণ বহুবিস্তৃত দৃষ্টিভঙ্গির বিপক্ষে যুক্তি দিয়েছেন ব্রউনমিলার। ‘নারীর প্রতি সংঘটিত ভয়াবহ ঘটনা ‘ধর্ষণ’কে তাঁদের আলোচনায় পুরোপুরি উপেক্ষা’ – এই মর্মে তিনি বিখ্যাত মনোবিজ্ঞানী রিচার্ড ভন ক্রাফট এবিং, সিগমান্ড ফ্রয়েড এবং সমাজবিজ্ঞানী ও দার্শনিক কার্ল মার্ক্স ও ফ্রেডরিক এঙ্গেলসের ব্যাপক সমালোচনা করেন।
তার বইটি বৈশ্বিকভাবে ধর্ষণের মতো সহিংসতার ঘটনা সম্পর্কে জনসাধারণের দৃষ্টিভঙ্গিতে পরিবর্তন, এমনকি আইন পরিবর্তনে প্রভাবশালী ভূমিকা রেখেছে বলে মনে করা হয়। সুতরাং যারা ‘ভিক্টমই দোষী কিংবা ‘আক্রান্ত ব্যক্তিই ধর্ষণের ঘটনার জন্য দায়ী’- এ ধরণের কথা-বক্তব্য মানতে নারাজ, তাদেও জন্য এ বইটি এখনো প্রাসঙ্গিক।
৬. শেইলা রোবোথাম, লিনি সিগাল ও হিলারি ওয়েইনরাইট-এর বিয়ন্ড দ্যা ফ্রাগমেন্টস (১৯৭৯) [Beyond the Fragments by Sheila Rowbotham, Lynne Segal, Hilary Wainwright (1979)]
বিয়ন্ড দ্যা ফ্রাগমেন্টস (১৯৭৯) বইটি মূলত; ৩ জন চিন্তুকের চিন্তার ফসল। তারা হলেন- শেইলা রোবোথাম (Sheila Rowbotham), লিনি সিগাল (Lynne Segal) ও হিলারি ওয়েইনরাইট (Hilary Wainwright)। একটি অসম সমাজ ব্যবস্থার জটিল সমস্যাগুলোকে ‘সমাজতান্ত্রিক নারীবাদী’ মতাদর্শের আলোকে দেখেছেন।
বইটি ১৯৭৯ সালে প্রকাশিত হলেও এর পদবাচ্যগুলো সমসাময়িক যুগের বিভিন্ন ইস্যুতে এখনো প্রাসঙ্গিক এবং বামপন্থি চিন্তাধারায় অত্যন্ত প্রভাবশীল। বিশেষকরে বামপন্থী বিভিন্ন চিন্তাধারার মাঝে সমন্বয়ের উপর জোরারোপ করেছেন লেখকত্রয়। এ বইতে শুধুমাত্র নারী ও রাষ্ট্রের সম্পর্ককেই নিরিক্ষা করা হয়নি; বরং সকল নারীবাদী অভিজ্ঞতা-ব্যক্তিগত জীবন থেকে রাজনৈতিক জীবন পর্যন্ত- গুরুত্ব দেয়া হয়েছে।
৭. বেল হুক্স এর আইন্ট এ উওম্যান: ব্ল্যাক উওমেন এ্যান্ড ফেমিনিজম (১৯৮১) [Ain’t I a Woman: Black Women and Feminism by bell hooks (1981)]
আর্থ-সামাজিক, শিক্ষা ও যৌন ক্ষেত্রে কালো নারীদের অবমূল্যায়ন নিয়ে বইটি লিখেছেন প্রখ্যাত চিন্তুক বেল হুক্স। বেল হুক্স লেখকের পেন নেইম, তার আসল নাম গ্লোরিয়া জিন ওয়াটকিনস (Gloria Jean Watkins)। গরীব ও প্রান্তিক নারীদের নিয়ে লেখালেখি হুক্স-এর কেন্দ্রীয় জায়গা। এবং এটিই তাকে অন্য নারীবাদীদের থেকে স্বতন্ত্র করেছে।
https://www.goodreads.com/book/show/250792.Ain_t_I_a_Woman]
১৯৮১ সালে লেখা এই বইটি গরীব ও কালো নারীদের দিশা দিয়েছিল যখন অন্য কোন আলো তাদের সামনে ছিল না, তাদের কথা বলা ও শোনার কেউ ছিল না। এমনকি আমেরিকার ফার্স্টলেডি যে একজন কালো নারী হতে পারবেন- সে বিষয়ে কেউ চিন্তাও করতে পারতো না। কালো জনগোষ্ঠীর অধিকার নিয়ে সোচ্চার ব্ল্যাক লাইভস ম্যাটারস-এর মতো সমসাময়িক আন্দোলনগুলোর শুরুর মালমসলা বা আন্দোলনের খোরাক তার লেখা থেকেই এসেছে।
বেল হুক্স-এর আরেকটি বিখ্যাত বই Feminist Theory: From Margin to Center (1984)। বইটিতে তিনি বিভিন্ন প্রমাণ উল্লেখ করে সমাজের নিম্নবর্গীয় এবং প্রান্তিক মানুষজনের কথা আলোচনা করেন।
৮. অ্যান্ড্রিয়া ডৌরকিন এর ইন্টারকোর্স (১৯৮৭) [Intercourse by Andrea Dworkin (1987)]
র্যাডিক্যাল নারীবাদী চিন্তাধারার অন্যতম একজন তাত্বিক অ্যান্ড্রিয়া ডৌরকিন (Andrea Dworkin)। তার অন্যান্য কাজ, যেমন Pornography: Men Possessing Women (1981) ও Intercourse (1987)– মতো এটিও একটি র্যাডিক্যাল ঘরানার বই।
[https://www.goodreads.com/book/show/163265.Intercourse]
এ বইটিতে হেটেরোসেক্সুয়াল যৌনতা বা যৌন সম্পর্ককে নারীর অধীনতা, ‘ভোগদখল’ ও অধ:পতন হিসেবে উপস্থাপন করা হয়েছে। ‘সকল হেটেরোসেক্সুয়াল যৌনতাই ধর্ষণ’-ডৌরকিনের বিখ্যাত একটি উক্তি, যেটি নিয়ে সমালোচনা রয়েছে- সে বিষয়টি অবশ্য এ বইতে বেশি আলোচনা করা হয়নি। তবে তার উক্ত উক্তি জনমানসে তাকে ‘পুরুষ বিদ্বেষী’ তকমা দিয়েছে। যাহোক যৌন সহিংসতা নিয়ে তার চিন্তাধারার স্বকীয়তা স্বীকৃত।
৯. নাওমি উলফ এর দ্যা বিউটি অব মিথ (১৯৯০) [The Beauty Myth by Naomi Wolf (1990)]
সৌন্দর্য ও নারী পরিচয়ের মধ্যকার সম্পর্কের বিষয়ে আমাদের দৃষ্টিভঙ্গিকে নতুন করে সংজ্ঞা প্রদানকারী একটি বেস্টসেলিং ক্লাসিক বই এটি। বইটি লিখেছেন নাওমি উলফ (Naomi Wolf )। তিনি একাধারে লেখক, সাংবাদিক, নারীবাদী এবং উদার গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক কর্মী। তৃতীয় ধারার নারীবাদের অন্যতম প্রধান প্রবক্তা হিসেবে স্বীকৃত।
ফ্যাশন ও সৌন্দর্য শিল্পকে বিশেষভাবে আক্রমণ করেন উলফ। তার মতে, আদর্শ সৌন্দর্যের যে ধারণা বর্তমান আধুনিক সময়ে বিরাজমান ও গ্রথিত তা পুরোপুরি পুরুষতান্ত্রিক সমাজের তৈরি। আর শুধুমাত্র নিজেদের কর্তৃত্ব বজায় রাখার জন্যই পুরুষতন্ত্র সৌন্দর্যের মত বিষয়টির উদ্ভাবন করেছে। এমনকি পুরুষতন্ত্র সৌন্দর্যের ক্ষেত্রে এমন একটি আদর্শ তৈরি করেছে যা একটি “ত্রুটিহীন সৌন্দর্য”র (“the flawless beauty.”) ধারণা সামনে আনে। এজন্যই তিনি এটিকে বিউটি মীথ বলে অভিহিত করেছেন।
তার মতে এই মীথ এতোটাই শক্তিশালী যে, এটি শারীরিক পরিপূর্ণতা বা ফিজিক্যাল পারফেকশন নিয়ে খোদ নারীদের মাঝেই একটি আবেশ তৈরি করেছে। এটি একজন আধুনিক নারীকে প্রত্যাশা, আত্মচেতনা এবং আত্ম-বিদ্বেষের একটি অন্তহীন সর্পিলের মধ্যে আটকে দেয়। আর সমাজের “ত্রুটিহীন সৌন্দর্য”র মতো অসম্ভব আদর্শটি পূরণ করতে যেয়ে নারীরা কাজ, ধর্ম, যৌনতা, সহিংসতা এবং ক্ষুধা- এই পাচটি ক্ষেত্রে ‘বিউটি মিথ’ দ্বারা লাঞ্চনার শিকার হচ্ছে বলে জানান উলফ। এমনকি এটি অর্জনে ব্যর্থতার জন্য নারীকে শারীরিক ও মানসিকভাবে দোষারোপ করা হয়।
তার মতে, নারীরা যতই বুদ্ধিমান, চতুর, মজার কিংবা প্রগতিশীল হোক না কেন- তাদের প্রতিনিয়ত এক অন্ধকার সত্যের মধ্য দিয়ে যেতে হয়। আর সেটি হলো- তাদের উরুর আকার সম্পর্কে খারাপ মনে করার চেষ্টা করা। তিনি বলেন, যৌনতার ক্ষেত্রে মহিলাদের আকাঙ্ক্ষাই বেশি বা নারীরা কামুদ- এই ধরনের বার্তার সমাজে সাধারণীকরণ হচ্ছে। এমনকি বর্তমান আধুনিক যুগে এ পরিস্থিতি দিন দিন আরো খারাপতর হচ্ছে, যেখানে [আধুনিক সময়ে] নারীর ক্ষমতা বা শক্তি এবং প্রাধান্য বাহ্যিকভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে বলে প্রতীয়মান হয়। আজকের বিশ্বে নারীদের আগের চেয়ে বেশি ক্ষমতা, আইনী স্বীকৃতি এবং পেশাদার সাফল্য রয়েছে। নারী আন্দোলনের সুস্পষ্ট অগ্রগতি দৃশ্যমান। কিন্তু নারীরা কিছুটা ভিন্ন ধরনের সামাজিক নিয়ন্ত্রণ দ্বারা গৃহকর্মী এবং স্ত্রীর চিরাচরিত চিত্রের মতোই সীমাবদ্ধ রয়ে গেছে বলে তিনি মনে করেন। উলফের মতে, নারীর প্রতি সহিংসতা সব কালেই সত্য এবং এখনো রয়েছে।
উলফকে কেউ কেউ বিতর্কিত, কখনও কখনও অসঙ্গত হিসাবে দেখেন তবে নারী নির্যাতনের বিষয়ে তাঁর দক্ষ বিশ্লেষণ দ্য বিউটি মিথটিকে আজও খুব প্রাসঙ্গিক করে তুলেছে।
১০. রোক্সানা গে এর ব্যাড ফেমিনিস্ট (২০১৪) [Bad Feminist by Roxane Gay (2014)]
এই বইটি নারীবাদী চিন্তার চতুর্থ ধারার ধ্রুপদী বই হিসেবে স্বীকৃত। বইটির লেখক রোক্সানা গে (Roxane Gay)। আমেরিকায় জন্ম নেয়া রোক্সানা গে একাধারে লেখক, শিক্ষাবিদ ও ভাষ্যকার হিসেবে পরিচিত।
[https://www.goodreads.com/book/show/35120802-bad-feminist]
২০১৪ সালে লেখা এ বইটি মূলত; গে-এর প্রবন্ধসমূহের সংকলন। তিনি এ বইতে বর্ণ, জাতি, ওজন, সেক্স, লিঙ্গীয় বিষয়াদি, সহিংসতা ও জনপ্রিয় সংস্কৃতি এবং এগুলোর মধ্যকার সম্পর্কের একটি নিরীক্ষা দাড় করিয়েছেন। নারীবাদী চিন্তাধারার সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক বিভিন্ন দিক নিয়ে আলোচনা করেছেন তিনি। নিউইউর্ক টাইমস-এর বেস্ট সেলার বইগুলোর মাঝে স্থান করে নেয়। বইটির বিভিন্ন প্রবন্ধে গে নারীবাদী হিসেবে তার ভূমিকা ব্যাখ্যা করার পাশাপাশি তার লেখালেখিতে নারীবাদী চিন্তাধারা প্রভাব নিয়েও কথা বলেছেন।
মূল লেখা: https://www.theguardian.com/books/2017/oct/09/ten-best-feminist-political-texts