Print Friendly, PDF & Email

 

বাংলাদেশে কয়েকমাস আগে একজন মুসলিম ধর্মগুরুর একটি বক্তব্য মিডিয়া ও নেটিজেনদের মধ্যে আলোড়ন তৈরি করেছিল (“বাংলাদেশি আলেমের ফতোয়া”, ২০২১)। তার বক্তব্যে তিনি মূলত কাওকে বিদ্রুপ করে ফেসবুকে হাহা দেয়ার বিষয়টিকে ইসলামী শরীয়াহ অনুযায়ী ব্যাখ্যা করেছেন। পরবর্তীতে, তার এই ভিডিও বার্তাটি ভাইরাল হয়; বহু অনলাইন সংবাদপত্রে “হাহা দেয়া হারাম” শীর্ষক সংবাদ প্রকাশিত হয়, দেশি – বিদেশি টিভি চ্যানেলে ও পত্রিকায় এটি নিয়ে আলোচনা হয় এবং সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে নানা ট্রল হয় (“Viral: ফেসবুকে ‘হাহা’ ইমোজির”, ২০২১)৷ এসকল আলোচনায় মূলত “হাহা দেয়া হারাম” – এই শব্দগুচ্ছই মূখ্য হয়ে দাঁড়িয়েছিল; বক্তব্যে আর কি কি বলা হয়েছে বা কিসের প্রেক্ষিতে বা নির্দিষ্টভাবে কোন বিষয়টিকে “হারাম” বলা হয়েছে, সেসব বিষয় গুরুত্ব পায় নি। কেন গুরুত্ব পায় নি বা এই ভিডিও বার্তাটি কেন এতো বিতর্কিত হলো তার প্রশ্ন খুঁজে পেতে সূক্ষ বিশ্লেষণ করা প্রয়োজন।

যদি আমরা নৃবিজ্ঞানের একাডেমিক ভাষায় বলি, তাহলে তার আলোচনাটি সম্পূর্ণ পরিপ্রেক্ষিত নির্ভর ছিল। তিনি আলোচনা করেছেন, কোন পরিপ্রেক্ষিতে হাহা দেয়া ইসলামী শরীয়াহর সাথে সাংঘর্ষিক নয় এবং কোন পরিপ্রেক্ষিতে সাংঘর্ষিক। সেই অনুযায়ী, কাওকে কষ্ট না দিয়ে রসিকতা করার ক্ষেত্রে “হাহা” দিতে কোনো নিষেধাজ্ঞা নেই। কেবল কাওকে বিদ্রুপ করে, কষ্ট দিয়ে “হাহা” রিএ্যাক্ট দেয়া ইসলামের শিক্ষাবিরোধী। কারণ ইসলামের শুরুর সময় থেকেই অন্যকে বিদ্রুপ করার উপর নিষেধাজ্ঞা রয়েছে।

  • অর্থাৎ, এখানে লক্ষ্য করবার মতো গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার হলো, বিদ্রুপ করার উপর নিষেধাজ্ঞা কোনোভাবেই ইসলামে নতুন কোনো বিষয় নয়।
  • এছাড়া কেবল ইসলাম নয়, বরং অনেক ধর্মেই পরস্পরকে বিদ্রুপ না করে সম্মান করার নির্দেশ দেয়া রয়েছে।

“আধুনিক” সভ্যতা ধারণকারী প্রত্যেক ব্যক্তি নির্দ্বিধায় এটা মেনে নেবে যে “অন্যকে বিদ্রুপ করা” অমানবিক, মানহানিকর। তাহলে এই ধর্মগুরুর বক্তব্যের একই সারমর্ম বহুজনের কাছে আপত্তিকর বলে মনে হলো কেন? এক্ষেত্রে, একটা গুরুত্বপূর্ণ দিক হতে পারে স্টিগমাটাইজেশন। সব ট্রলগুলোতেই “হারাম” শব্দটিকে সবার দৃষ্টিগোচর করা হয়েছে। বার্তার মূল বক্তব্যের পরিপ্রেক্ষিতকে ছাপিয়ে এই একটি শব্দ হাঙ্গামা তৈরি করেছে, কারণ এখানে “হারাম” শব্দটি একটি স্টিগমাটাইজড শব্দের কাজ করেছে। যখনই “হারাম” শব্দটির কথা শোনা হয়, তখনই ইসলাম ধর্মের কথা এবং সেইসাথে এই ধর্মের বেশকিছু বৈশিষ্ট্যের কথা মাথায় আসে। যেমন- কিছু প্রচলিত ধারণা হলো ইসলাম ধর্ম রক্ষণশীল, আধুনিকতাকে মেনে নিতে পারে না ইত্যাদি৷ ফলে আধুনিক যুগের কোনো বিষয়কে যখন কেউ ইসলামিক মূল্যবোধ দ্বারা ব্যাখ্যা করতে যায় এবং ব্যাখ্যা করতে যেয়ে ইসলামিক শব্দকোষ থেকে “হারাম”, “হালাল” প্রভৃতি শব্দ ব্যবহার করে, তখন তা ভিন্ন দ্যোতনা তৈরি করে। এসকল শব্দ শোনার পরপরই মনে হতে থাকে যে ইসলাম তার রক্ষণশীল দৃষ্টিভঙ্গি দ্বারা আধুনিকতায় বাধ সাধছে। এই লেখায় উল্লেখিত ধর্মগুরু “হারাম” শব্দটি প্রয়োগ না করে, যদি কেবল বিদ্রুপ করে কাওকে কষ্ট না দেয়ার পরামর্শ দিতেন তাহলে পরিস্থিতিটা এমন নাও হতে পারত।

এখন প্রশ্ন আসে এই স্টিগমাটাইজেশন কেন হলো? সাম্প্রতিক বিশ্বের পাবলিক পরিসর এবং একাডেমিক মহল – উভয় ক্ষেত্রেই আলোচনার একটি অন্যতম বিষয়বস্তু হলো ইসলামোফোবিয়া। মোটাদাগে ইসলামোফোবিয়া বলতে বুঝায়, মুসলিমদের সাথে তাদের ধর্মীয় পরিচয়, বিশ্বাসের কারণে বৈষম্যমূলক আচরণ করা ও তাদের সম্পর্কে নেতিবাচক ধারণা পোষণ করা। প্রিজিউডিস স্টাডিজ, পোস্টকলোনিয়ালিটি ও রেসিজম স্টাডিজ, ডিকলোনিয়ালিটি স্টাডিজ সহ নানা জ্ঞানকান্ড নানাভাবে তাদের আলোচনায় ইসলামোফোবিয়াকে ব্যাখ্যা করেছে (Hafez, 2018)। তবে এসকল আলোচনার মধ্যে একটি বড় অংশের ভর হলো পশ্চিমা বিশ্বে বিদ্যমান থাকা ইসলামোফোবিয়ার উপর। এসকল আলোচনা থেকে মনে হতে পারে কেবল মুসলিম সংখ্যালঘু পশ্চিমা দেশ গুলোতেই ইসলামোফোবিয়ার অস্তিত্ব রয়েছে। কিন্তু Bayrakli, Hafez এবং Faytre (2019) এর কাজ ইসলামোফোবিয়াকে নিয়ে আরো বিস্তৃতভাবে ভাববার পথ বাতলে দিয়েছে। তারা এপিস্টেমিক ইসলামোফোবিয়া, সেকুলারিজম, সেল্ফ ওরিয়েন্টালিকম এর মত নানা তাত্ত্বিক দৃষ্টিকোণ থেকে দেখিয়েছেন যে, এটির অস্তিত্ব কেবল পশ্চিমা বিশ্বের মুসলিম সংখ্যালঘু দেশগুলোতেই নয়, বরং মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশগুলোতেও বিদ্যমান রয়েছে। বাংলাদেশে ঘটে যাওয়া উপরোক্ত ঘটনাকে তাদের আলোচনার প্রেক্ষিতে স্থাপন করে দেখলে বাংলাদেশের মতো মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ এবং আপাতদৃষ্টিতে ধর্মপ্রাণ মুসলিম জনগণের দেশেও ইসলামোফোবিয়া খুঁজে পাওয়া যেতে পারে।

তারা ইসলামোফোবিয়াকে সংখ্যালঘু-সংখ্যাগরিষ্ঠ এর মধ্যকার সম্পর্কের বিষয় মনে করেন না; বরং ক্ষমতাশালী ও ক্ষমতাহীনের মধ্যকার সম্পর্কের বিষয় মনে করেন। মুসলিমদের কিছু অংশ নিজেদের পরিচয়, ঐতিহ্য, দৃষ্টিভঙ্গিকে একটি বহিরাগত (alien) দৃষ্টিভঙ্গি অর্থাৎ পশ্চিমা দৃষ্টিভঙ্গিতে দেখে। এই ক্ষমতাশালী মুসলিম এলিট দল ক্ষমতাহীন ‘রক্ষণশীল’ মুসলিমদেরকে পশ্চিমা সেকুলারিজম ও তাদের ক্ষমতার জন্য হুমকি হিসেবে দেখে। ফলে এই ‘রক্ষণশীল’ মুসলিমদের চর্চা, ব্যবহৃত শব্দকোষও তাদের জন্য হুমকিস্বরুপ, যা কিনা স্টিগমাটাইজেশনের পেছনে ভূমিকা রাখে।

 

রেফারেন্সঃ

বাংলাদেশি আলেমের ফতোয়া: ফেসবুকে “হা হা” হারাম! (২০২১, জুন ২৩)। ঢাকা ট্রিবিউনhttps://bangla.dhakatribune.com/others/2021/06/23/35784

Bayrakli, E., Hafez, F. & Faytre, L. (2019). Making sense of Islamophobia in Muslim societies. In E. Bayrakh & F. Hafez (Eds.) Islamophobia in muslim majority societies (pp. 5-20). Routledge.

Hafez, F. (2018). Schools of Thought in Islamophobia Studies: Prejudice, Racism, and Decoloniality. Islamophobia Studies Journal, 4(2), pp. 210-225. https://www.jstor.org/stable/10.13169/islastudj.4.2.0210

Viral: ফেসবুকে ‘হাহা’ ইমোজির ব্যবহার বন্ধে ফতোয়া জারি বাংলাদেশি ধর্মগুরুর। ( ২০২১, জুন ২৫) আনন্দবাজার পত্রিকাhttps://www.anandabazar.com/world/bangladeshi-cleric-ahmadullah-has-issued-a-fatwa-against-people-for-using-the-haha-emoji-on-facebook-to-mock-others-dgtl/cid/1289018

লেখক: তানজীলা আক্তার আখি, স্নাতক সম্মান – ৪র্থ বর্ষ, নৃবিজ্ঞান বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়

[লেখার সকল দায়বদ্ধতা লেখক সংরক্ষণ করবেন]

ইমেইল- tanzilaakter91200@gmail.com

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here