Print Friendly, PDF & Email

 

মিসাহারাতিদের প্রয়োজনীয়তা কমে গেলেও আম্মানের ঐতিহ্যবাহী মহিমাকীর্তনকারীরা এখনও সুহুর খাবারের জন্য মানুষজনকে জাগিয়ে তোলেন।

মিসাহারাতিরা রমজান মাসে সুহুর হিসেবে পরিচিত প্রাক-ভোরের খাবারের জন্য মানুষজনকে জাগিয়ে তোলেন। [আরিজ আবুকুদাইরি/আল জাজিরা]

জায়েদ দাইফাল্লাহ পবিত্র রমজান মাসে প্রতিদিন ভোর ২টার দিকে কেবল একটি ড্রাম এবং লাঠি হাতে তার বাড়ি থেকে বের হন। তিনি সবার কাছে আবু বাশার নামে পরিচিত। তিনি অর্ধচন্দ্র, তারা এবং লণ্ঠন আকৃতির ঝলকানি আলো দিয়ে সজ্জিত ছোট ছোট গলিপথের মধ্যে হেঁটে হেঁটে তার ড্রাম বাজাতে থাকেন। ড্রামের আওয়াজ বাড়তে থাকলে শিশুরা তার কাছে এসে তাকে ঘিরে ধরে।

এভাবে দাইফাল্লাহ পূর্ব আম্মানের উইহদাত ক্যাম্পের বাসিন্দাদের স্মরণ করিয়ে দেন যে, এটি সুহুরের সময়। সুহুর হলো একটি খাবার যা মুসলমানরা পবিত্র রমজান মাসে তাদের দৈনিক রোজা শুরু করার আগে ভোরবেলায় খান।

“[আজ থেকে] বিশ বছর আগে, এই মুহূর্তে [ভোর ২টার দিকে] কেউ জেগে না ওঠায় এই সরু রাস্তাগুলো খালি এবং অন্ধকার/অন্ধকারাচ্ছন্ন ছিল,” তার পেশা কীভাবে বিকশিত হয়েছে সে সম্পর্কে আল জাজিরার সাথে সাক্ষাৎকারে ৪২ বছর বয়সী দাইফাল্লাহ স্মরণ করে বলছিলেন।  “আমি একটি রাস্তাও ছেড়ে যেতাম না যতক্ষণ না পর্যন্ত আমি দেখতাম যে সকল বাড়িতে আলো জ্বলতো এবং লোকেরা ঘুম থেকে উঠতো,” তিনি যোগ করেন।

সেহরীর জন্য পাড়া-প্রতিবেশিদের জাগানোর প্রথাটি ইসলামের শুরুর দিক থেকেই বিদ্যমান। আর সেহরী খাবার গ্রহণ সম্পর্কে নবী মুহাম্মদ [সা.] সবিশেষ গুরুত্বারোপ করেছেন। তিনি মুসলমানদের [সুহুর] খাবার খেতে উৎসাহিত করেছেন। নবীর একটি বাণীতে (হাদীসে) তিনি বলেছেন: “[তোমরা] সেহরি খাও, কেননা এতে বরকত রয়েছে।”

[সুহুরে জাগানোর প্রথার ইতিহাস সম্পর্কে] জর্ডানের ইসলাম বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের ইসলামের ইতিহাস বিশেষজ্ঞ আব্দুল রহমান ইবদা ব্যাখ্যা করে বলেন, “নবী মুহাম্মদের [সা.] সময়, ফজরের (ভোরের) নামাযের প্রকৃত আযানের আগে মানুষজনকে সেহরী খেতে সতর্ক করার জন্য নামাজের আহ্বান তথা আযান দেয়া হতো। আর ফজরের  আযানের জন্য একটি আযান ব্যবহার করা হত, যার পরে [রোযা রাখতে ইচ্ছুক] লোকজন খাওয়া থেকে বিরত থাকেন।”

মিসাহারাতি ইসলামী শিক্ষার অংশও নয়; আবার বিরোধীও নয়। এটির প্রয়োজনীয়তা বৃদ্ধির সাথে সাথে এটি বিকশিত হয়েছে, “তিনি আল জাজিরাকে বলেন।

বেশ কয়েকজন ঐতিহাসিক বিশ্বাস করেন যে, মিসাহারাতি প্রথাটি ৮৫৩ সালে মিশরে সর্বপ্রথম আবির্ভূত হয়েছিল। সে সময়কার মিশরের গভর্নর ওতবাহ বিন ইসাক সুহুর খাওয়ার জন্য কায়রোর রাস্তা দিয়ে হেঁটে যাওয়ার সময় এই ঐতিহ্য শুরু করেছিলেন। এই মিসাহারতির ঐতিহ্যবাহী মন্ত্র হল ঈশ্বরকে স্মরণ করতে মানুষের জন্য একটি জাগরণী আহ্বান: “সৃষ্টিকর্তার উপাসনা করার জন্য জেগে উঠুন।”

১১ শতাব্দীরও বেশি সময় পর, বর্তমানে প্রযুক্তির উপর বেশিরভাগ জর্ডানিয়ানদের নির্ভরতার সময়েও এই ঐতিহ্যটিকে বাঁচিয়ে রাখতে কিছু মিসাহারতি এখনও আম্মানের রাস্তায় ঘুরে বেড়াচ্ছেন, সংগ্রাম করছেন। মানুষ অ্যালার্ম ঘড়ি এবং মোবাইল ফোন ব্যবহারে অভ্যস্ত হওয়ার আগে মিসহারাতি  একটি গুরুত্বপূর্ণ পেশা ছিল।

আবু সাদ মোগরাবি বলেন, “শিল্পের এই মূল্যবান রূপটি যেভাবে হারিয়ে যাচ্ছে তা খুবই দুঃখজনক,।” তিনি একজন মুসাহারাতি। তিনি তার পিতার কাছ থেকে এই চর্চাটি উত্তরাধিকার সূত্রে পেয়েছেন, যিনি একজন সুফিবাদ বা আধ্যাত্মিক ইসলামের অনুসারী।

৫০ বছর বয়সী এই মিসাহারাতি দিনের বেলা আম্মান শহরের কেন্দ্রস্থলে একটি জুস বারে কাজ করেন। তিনি বলেন, তিনি জাবাল আল-হুসেনের আশেপাশের রাস্তায় ঘুরে বেড়িয়ে সবাইকে জাগানোর দায়িত্ব বোধ করেন। এটি সেই একই জায়গা যেখান থেকে তিনি ৩০ বছরেরও বেশি সময় আগে সুহুরের জন্য মানুষদের ডাকতে শুরু করেছিলেন।

“ছোটবেলায় আমি একটি লণ্ঠন ধরে বাবার সাথে সাথে হাঁটতাম। এই রাস্তাগুলোর সাথে আমি একটি শক্তিশালী আধ্যাত্মিক টান অনুভব করি,” তিনি আল জাজিরাকে বলছিলেন।

সন্তানদের জন্য সুহুর তৈরি করতে নিজেকে জাগিয়ে তোলার জন্য কীভাবে ড্রামের বাজনা এবং মিসাহারাতি’র মহিমাকীর্তনের উপর নির্ভর করতেন, সে সম্পর্কে বাড়ির বাইরে বেঞ্চে বসে জামিলা ইউসুফ স্মৃতিচারণ করেন। “সেইসময়, পুরো ক্যাম্পে একটি মাত্র পরিবার ছিল যার একটি তিন-দিনার ($5) মূল্যের অ্যালার্ম ঘড়ি কেনার সামর্থ্য ছিল,” ৬০ বছর বয়সী [জামিলা] বলছিলেন।

“আজকাল, পরিবারের প্রতিটি ব্যক্তিরই অন্তত একটি করে মোবাইল ফোন থাকে এবং তারা কোন সমস্যা ছাড়াই [সুহুরের সময়] জেগে ওঠে।”

জর্ডানে এখনও কতজন মিসাহারাতি কাজ করেন সে সম্পর্কে সরকারী গবেষণা এবং পরিসংখ্যানের নেই। তবে, ড্রাম বিক্রিকারী ব্যবসায়ীদের সংখ্যা ব্যাপকভাবে হ্রাস পেয়েছে। পূর্ব আম্মানের একজন ড্রাম বিক্রেতা হামাদা সাইদি বলেন, “আগে, আমি ড্রাম বিক্রি করতাম, এবং আজকাল আমি সেগুলো শুধুমাত্র ভাড়া দিই বা বিনামূল্যে মিসাহারাতিদের কাছে ধার দিই।”

মিসাহারাতির প্রয়োজনীয়তা কমে যাওয়ায় তাদের [ঐতিহ্যবাহী] ভূমিকাটি বর্তমানে শিশুদের বিনোদনের উৎসে পরিণত হয়েছে। সেই কারণে ২০ বছর আগে মিসাহারাতিরা যে ঐতিহ্যবাহী মন্ত্রগুলো গেয়েছিল আজকে শোনা মন্ত্রগুলো তার থেকে আলাদা। আবু বাশার বলেন, “আমি এই শিশুদের সাথে গান করি যাতে তারা মজা করতে চায়।”

বহু মিসাহারাতি সুফি এবং অন্যান্য ইসলামিক গান ও মহিমাকীর্তনগুলোর মিশ্রণ গেয়ে সেই পরিবর্তনের সাথে খাপ খাইয়ে নিয়েছেন। “আমাদের বাবা একজন দরবেশ ছিলেন, তাই তিনি আমাদের শিখিয়েছিলেন যে পেশাটি কেবল ঢোল পিটিয়ে নেওয়ার চেয়েও বেশি কিছু,” আবু আসাদ বলেছিলেন।

পশ্চিম এবং উত্তর আম্মানের ধনী এলাকাগুলোর বাসিন্দারা বলছেন মিসাহারাতিরা প্রায় বিলুপ্ত হয়ে গেছে।

আকরাম খুরাইসাত উত্তর আম্মানের জুবাইহা পাড়ায় বসবাস করেন। তিনি একজন প্রকৌশলী। তিনি বলেন, “[মিসাহারাতিদের] কেউ কেউ মাঝে মধ্যে আসেন, এবং কখনো সখনো আমরা আশেপাশের এলাকা থেকে [তাদের] আহ্বানের প্রতিধ্বনি শুনতে পাই।”

“রমজান যখন গ্রীষ্মকালে হয়, অনেক পরিবারই তখন প্রায় দেরি করে জেগে থাকে যতক্ষণ না পর্যন্ত মিসাহারাতিরা ড্রাম বাজানো শুরু করেন,” খুরাইসাত বলেছিলেন।

শেষ পর্যন্ত, আবু আসাদ এবং আবু বাশারের মতো মিসাহারাতিদের জন্য এই পেশাটি এমন একটি জীবনধারায় পরিণত হয়েছে যা তারা পরিত্যাগ করতে পারে না।

আবু আসাদ বলেন, “প্রতি বছরই আমি বলি আমি বৃদ্ধ হয়ে যাচ্ছি এবং ক্লান্ত হয়ে যাচ্ছি। এবং [হয়তো] এই বছরটিই আমার শেষ বছর হতে পারে। কিন্তু প্রতি বছর রমজানের প্রথম দিন থেকেই আমি নিজকে ড্রাম হাতে নিয়ে ভোর ২টায় বাড়ি থেকে বের হতে দেখি।”

https://www.aljazeera.com/news/2014/7/27/the-last-of-jordans-ramadan-singers

অনুবাদক:

খলীলুল্লাহ মুহাম্মাদ বায়েজীদ, শান্ত-মারিয়াম ইউনিভার্সিটি অব ক্রিয়েটিভ টেকনোলজি’র সমাজবিজ্ঞান ও নৃবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষক। আগ্রহের জায়গা- জনসংস্কৃতি, স্মার্টফোন ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম, ধর্ম ও সেক্যুলারিজম।

ইমেইল: bayezid407@gmail.com

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here