Print Friendly, PDF & Email

বোয়াস ১৮৫৮ সালের ৯ ই জুলাই জার্মানিতে জন্মগ্রহণ করেন। তার বাবা ছিলেন একজন সমৃদ্ধশালী ব্যবসায়ী ও মা ছিলেন সমাজ ও রাজনৈতিক কর্মকান্ডে অত্যন্ত সক্রিয় একজন ব্যক্তিত্ব। বোয়াস হেডেলবার্গ, বন এবং কিয়েলে পড়াশোনা করেন। প্রথমে তিনি পারদর্শীতা লাভ করেন পদার্থ ও গনিতে। পরবর্তী পর্যায়ে প্রাকৃতিক সাংস্কৃতিক ভূগোলে আগ্রহী হন। ১৮৮১ সালে তিনি সমুদ্রের পানির রং এর উপর থিসিস করেন। জার্মান সেনাদের অফিসার প্রশিক্ষণ কর্মসূচিতে এক বৎসর প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন। এর পরে আরও এক বৎসর পড়াশোনা কাজেই কাটান। ১৮৮৩ সালে বোয়াস তার নৃতাত্ত্বিক গবেষণার কর্মধারা ব্যাফিনল্যান্ডে যাত্রার মাধ্যমে আরম্ভ করেন। বোয়াসের অনেক সঙ্গী ও ছাত্ররা নৃতাত্ত্বিক গবেষণায় তার অনুপ্রবেশ এবং তার আগ্রহ সম্পর্কে বর্ননার চেষ্টা করেছেন। কারো মতে বোয়াস তার প্রথম অভিযাত্রায় এস্কিমোর রং কে বিভিন্ন শ্রেণীতে বিভক্ত করেন যা তাদের সমুদ্রের পানির রং প্রত্যক্ষণ এর ক্ষেত্রে প্রভাব ফেলে এবং এখান থেকেই বোয়াস সংস্কৃতির গুরুত্ব শিকার করেন। হারসকভিটিস এটাকে কাল্পনিক বলে অভিহিত করেন এবং তিনি আরো বলেন যে এই যাত্রার মাধ্যমে বোয়াস আদিবাসীদের অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ সংস্পর্শে আসেন। তিনি নিজেই এই সময় সম্পর্কে লিখেছেন ‘এখন আমি আমার জাতি তাত্ত্বিক গবেষণা আরম্ভ করেছি’ বোয়াস আবেগ প্রবন অনুভূতি নিয়ে এস্কিমোদের সম্পর্কে বলেন ‘আমি দেখেছি যে তারা জীবনকে উপভোগ করে এবং এদের জীবন আমাদের মতো কঠিন’।

বোয়াস যে সমস্ত পদে অধিষ্ঠিত ছিলেন :

ব্যাফিনল্যান্ড থেকে প্রত্যাবর্তনের পর এক বছর (১৮৮৪-১৮৮৫) তিনি নিউ ইয়র্কে অবস্থান করেন এবং জাদুঘরের একজন সহযোগী হিসাবে জার্মানিতে ফিরে আসেন। যে জাদুঘরের প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন প্রখ্যাত নৃবিজ্ঞানী এডলফ যিনি সেখানে বসতেন। তিনি ১৮৮৬ সালে বার্লিন বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন ভূগোলের ডসেন্ট (Docent) হিসেবে একদল Bella Colla ইন্ডিয়ানদের উপর গবেষণা পরিচালনা করেন। ১৮৮৭ সালে এই যাত্রার সমাপনে তিনি নিউ ইয়র্কে ফিরে যান এবং সাইন্স প্রকাশনার একজন সহকারী সম্পাদক নিযুক্ত হন। ওই একই বছর তিনি বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন এবং আমেরিকার নাগরিক হন। বোয়াস ক্লার্ক বিশ্ববিদ্যালয়ে ১৮৮৮ থেকে ১৮৯২ পর্যন্ত কাজ করেন। শিকাগো গবেষনার যাত্রার জন্য সেখানকার নৃবিজ্ঞান বিভাগের প্রধান সহকারীর পদ গ্রহণ করেন ১৮৯৫ সালে নৃতাত্তিক জাদুঘরের একজন কিউরেটর হিসেবে নিযুক্ত হন। এথনোলজী এবং সোমাটোলজীর কিউরেটর হিসেবে আমেরিকার জাদুঘরেও কাজ করেন। ১৮৯৩ সালে শিকাগোর বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য নৃতাত্তিক গবেষণা সমূহ কে সংগঠিত করেন। ১৮৯৬ সালে কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগদান করেন সেখানে তিনি ১৯৪২ সন অর্থাৎ তার মৃত্যু পর্যন্ত নিষ্ঠার সাথে কাজ করে যান। বোয়াসের অন্যান্য কাজের মধ্যে রয়েছে- তিনি ১৯১০ সালে নিউইয়র্ক একাডেমীক অফ সাইন্স এর সভাপতি ছিলেন । তাকে অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সম্মানসূচক ডি-লিট ডিগ্রি দেওয়া হয়। বোয়াস American Folklore Society এর প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন। ১৯০০ সনে American Ethnologic Society কে পুনরুজ্জীবিত করেন। বোয়াস একটি পেশাজীবি সংগঠন The American Anthropological Association গড়ে তুলবার জন্যে তৎকালীন Bureau of Ethonogology ভিউ অফ ইথনোলজি এর প্রধান ডব্লিউ ভেম্যাকগি কে উপদেশ প্রদান করেন । ১৯০১ সনের ব্যুরো অফ অ্যামেরিকান এথনোলজীতে একজন সম্মানিত ভাষাতাত্ত্বিক হিসাবে যোগদান করেন। ১৯০৭ সনে তিনি এর প্রেসিডেন্ট পদে অধিষ্ঠিত হন। কার্ডিনার এবং প্রেবেলের মতে নৃতাত্ত্বিকদের পেশাজীবী পত্রিকায় ছয়-শতের বেশি প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়। কিন্তু ম্যালেফিট এর মতে বোয়াসের মোট প্রবন্ধের সংখ্যা সাত-শতের মত। তার The mind of primitive man ( ১৯১১) সালে প্রকাশিত হয়। এরপর একাধারে (১৯২৭) সালে তিনি রচনা করেন আরেক টি গ্রন্থ Primitive Art অতঃপর প্রকাশিত হয় Anthropology and modern life (১৯২৮) সালে। (১৯৩৮) সালে বোয়াসের General Anthropology এবং তার Primitive man এর এর সংশোধিত সংস্করণ প্রকাশিত হয়। (১৯৪০) সালে Race language and Culture এই শিরোনামে বোয়াসের অত্যন্ত মূল্যবান ও গুরুত্বপূর্ণ গবেষণা কর্ম প্রকাশিত হয়।

বোয়াস একজন প্রখ্যাত আমেরিকান নৃবিজ্ঞানী এবং একজন মহান শিক্ষক যিনি অনেক বিখ্যাত নৃবিজ্ঞানীগনক দীক্ষা দিয়েছেন। তারা বলেন, বোয়াস যে কোন ধরনের কর্তৃত্বকে ঘৃণা করতেন। তিনি সারা জীবন এর বিরুদ্ধে এমনকি নিজের বিরুদ্ধে ও সংগ্রাম করেছেন। বোয়াস শেষ জীবনে ব্যাক্তিগত দুঃখ কষ্টে ভরাক্রান্ত ছিলেন। কারণ হঠাৎ করে তার ছয় সন্তানের মধ্যে দুই সন্তান সড়ক দুর্ঘটনায় মৃত্যুবরণ করেন । ১৯২৯ সালে তার পত্নী ও সড়ক দুর্ঘটনায় মৃত্যুবরণ করেন ।১৯৩১ সালে ৭৩ বছর বয়সে তিনি হৃদরোগে আক্রান্ত হন কিন্তু তিনি সেই রোগ থেকে আরোগ্য লাভ করেন এবং নিজের কাজে ফিরে যান। পরবর্তীতে ১১ বছর তিনি কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয় কাজ চালিয়ে যান এবং হঠাৎ করে ১৯৪২ সালের ২১ শে ডিসেম্বর বিশ্ববিদ্যালয়ের ফ্যাকাল্টি ক্লাবের আয়োজিত ভোজন সভায় মৃত্যুবরণ করেন।

বোয়াসের অবদানঃ

বোয়াসের আপেক্ষিক অর্থে কম সংখ্যাক গ্রন্থেও রচয়িতা কার্ডিনার এবং প্রেবেলের মতে নৃতাত্তিকদের পেশাজীবি পত্রিকায় তার ছয়-শতের ও বেশি প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়। কিন্ত ম্যালেফিট এর মতে বোয়াসের মোট প্রবন্ধের সংখ্যা মতে সাত শতের মত। তার উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ Primitive Art, অতঃপর প্রকাশিত হয় Anthropology and Modern life ১৯২৮ সনে, ১৯৩৮ সনে বোয়াসের General Anthropology এবং তার Primitive Man এর সংশোধিত সংস্করণ প্রকাশিত হয়। এরপর ১৯৪০ সনে Race, Language and culture  এই শিরোনামে বোয়াসের অত্যন্ত মূল্যবান ও গুরুত্বপূর্ণ গবেষণা কর্ম প্রকাশিত হয়।

বোয়াসের তত্ত্বসমূহ

১.   বোয়াসের জাতিতত্ত্ব বিদ্যা এবং বিবর্তনবাদ

জাতিতত্ত্ব বিদ্যার কাজ হচ্ছে সামাজিক জীবনের সামগ্রিক ঘটনাবলী সম্পর্কে জানবার চেষ্টা করা। ভাষা, প্রথা, স্থানান্তর, দৈহিক বৈশিষ্ট্য ইত্যাদি হচ্ছে জাতিতত্তবিদের গবেষণার বিষয়। ফলে তার প্রথম এবং প্রধান পাঠের বিষয় হচ্ছে মানবজাতির ইতিহাস। মানবজাতির ইতিহাস বলতে শুধুমাত্র সভ্য জাতিসমূহের নয় অর্থাৎ সমগ্র মানব জাতির বরফ যুগ থেকে আজকের আধুনিক যুগ পর্যন্ত।

জাতিতত্ত্ব বিদদের আরও কাজ হচ্ছে সংস্কৃতিক ক্রমবর্ধমান উন্নয়ন ও অভিব্যাক্তি অনুধাবন করা।

বোয়াস বলেন যে কতকগুলো নিয়ম বিদ্যমান যা মানব সংস্কৃতির উন্নয়নকে নির্ধারণ করে। নৃতাত্ত্বিকের কাজ হচ্ছে সেই নিয়ম সমূহকে আবিস্কার করে যে সংস্কৃতির উন্নয়নের ভিত্তি উল্লেখ্যযোগ্য ভাবে সমরুপ। কতকগুলো আইন বিদ্যমান যেগুলো এই উন্নয়নের সঙ্গে সম্পর্কিত। ব্যালেফিট বলেন যে, ১৮৯৬ সনে বোয়াস কর্তৃক বিবর্তনবাদকে আরও জোরদার করেছিল।

২.   ঐতিহাসিক পদ্ধতিঃ

বোয়াস তুলনামূলক পদ্ধতিতে অসন্তোষ প্রকাশ করেন এবং এর পরিবর্তে ঐতিহাসিক পদ্ধতি গ্রহন করার প্রস্তাব দেন। তিনি আরও পরামর্শ দেন যে ঐতিহাসিক পদ্ধতিকে এই নীতির উপর ভিত্তি করতে হবে যে সমরুপ সামাজিক প্রপঞ্চ সর্বদাই একই কারনে উদ্ভত নয়, এবং প্রত্যেক ঘটনার জন্য অভিব্রতালব্ধ তথ্যের ভিত্তিতে একটি সাধারণ কারণ প্রতিষ্টা করতে হবে। বোয়াস জানতেন যে এটি একটি ধীর ও কঠিন কাজ, কিন্তু এটি সাংস্কৃতিক উন্নয়নের ইতিহাসকে যথার্থতার সাথে পুনর্গঠিত করবে।

বোয়াসের মতে ইতিহাসের সাধারণ উৎপত্তি স্থল হচ্ছে সাংস্কৃতিক অভিন্নতার সাধারণ কারন। তিনি মানব মনের সমরুপিতা এ্ই ধারণাকে পরিহার করেন কেন না মানুষ সর্বত্রই একই নিয়ম পালন করে না। বোয়াস পরিবেশের সাদৃশ্যতা এই নিয়মের ও বিরোধিতা করেন। কারণ এটা দেখান ও সম্ভব যে বিভিন্ন ধরনের সংস্কৃতি একই ধরনের পরিবেশ আবার একই সংস্কৃতি ভিন্ন ভিন্ন পরিবেশে দেখা যায়। একই ঐতিহাসিক উৎপত্তিস্থল সর্ব সময় নিশ্চিতভাবে গ্রহনযোগ্য নয়। তবে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র নির্দিষ্ট ভৌগোলিক এলাকায় যদি একই ধরনের সাংস্কৃতিক জীবন লক্ষ্য করা যায় তবে তার ঐতিহাসিক যোগসূত্র নির্নয়ই হবে তার উৎকৃষ্ট প্রমান।

এটা নিশ্চিত যে বোয়াসের ঐতিহাসিক পদ্ধতি সাধারণ নিয়মের অস্তিত্বকে অস্বীকার করে কারণ তিনি ধরে নেন যে বিশেষ কিছু সীমিত ভেীগোলিক এলাকা ব্যাতিত সমরুপ পপঞ্চ সমরুপ কারণ থেকে উৎসারিত নয়।

এভাবে বোয়াস ক্রমান্নয়ে নৃবিজ্ঞানে যে তত্ত্ব দেন তা Historical Particularism বলে পরিচিত।

বোয়াস ছিলেন একজন স্পষ্ট বক্তা, তাই তিনি তার সত্য অভিজ্ঞতা উপস্থাপন করেছেন। সেটা উপভোগ্য হোক আর না হোক। যদিও বোয়াস বহুল পরিমানে তথ্য সংগ্রহ করেন এবং বলা হয় যে কোন বিশ্লেষনে তা ব্যবহার যোগ্য। কিন্তু তথ্য যদি তত্ত¡ দাড় করানোর উদ্দেশ্য ছাড়া সংগৃহীত হয় তবে তা বিজ্ঞান সম্মত কাজের জন্য খুব একটা উপযোগী নয়। ফলে সেই বিপুল তথ্য যে কোন গবেষণাকে বিভ্রান্ত করতে পারে যদি সেই তথ্যকে ব্যবহার করার কোন নির্দিষ্ট উদ্দেশ্য না থাকে।

বোয়াস নরগোষ্ঠিগত ভাষাতত্ত¡ এবং সাংস্কৃতিক আপেক্ষিকতার পক্ষে দাড়ান যা আধুনিক নৃবিজ্ঞানীদের দৃষ্টিভঙ্গির সঙ্গে সামাঞ্জস্যপূর্ন। বোয়াস অনেক বিখ্যাত নৃবিজ্ঞানীকে শিক্ষা প্রদান করেছেন এবং আমেরিকার নৃবিজ্ঞানের নায়ক হিসেবে খ্যাতি অর্জন করেছেন তথাপি নৃবিজ্ঞানে কোন পৃথক বোয়াস স্কুল বা মতবাদ নাই। এর প্রধান কারন হচ্ছে বোয়াসের মানব সমাজ সম্পর্কে দোদুল্যমান ধারনা। কারন আমরা তাকে প্রথম দেখি বিবর্তনবাদীদের পক্ষে দাড়াতে এবং বিবর্তনবাদীদের সাধারণ নিয়ম আবিষ্কার করতে। তাকে আমরা আবার দেখি বিবর্তনবাদকে বাদ দিয়ে Historical Particularism –এর দিকে মনোনিবেশ করতে। পরিশেষে তিনি দেখেণ ব্যাক্তিকে সমাজ পরিবর্তনের কারণ ও ফলাফল দুইই হিসেবে।

পরিশেষে বলা যায় বোয়াস গোড়া ছিলেন না। তিনি ছিলেন গতিশীল এবং বিপ্লবী। এই অর্থে যে তিনি সত্যকে গ্রহণ করেন এমনকি যখন সেটা তার ধারনার বিরুদ্ধে ও অবস্থান করেছে।

Writings of Boas

তথ্যসূত্র:

নৃতাত্ত্বিক চিন্তা- মুহাম্মাদ হাবিবুর রহমান (১৯৯২)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here