পরিবেশ ধ্বংসে প্রাকৃতিক ও মানবসৃষ্ট উভয় ধরণের ফ্যাক্টরকেই দায়ী করা হয়। তবে বর্তমানে বিজ্ঞানীরা মানবসৃষ্ট কারণগুলোকে বেশ গুরুত্বের সাথে বিবেচনা করছেন। মূলত; বিংশ ও একবিংশ শতাব্দীতে জলবায়ু পরিবর্তন ও বৈশ্বিক উষ্ণায়নকে সামনে রেখে তারা কাজ করে যাচ্ছেন। তাদের এ কাজে উদাহরণ হিসেবে বিশ্ববাসীর কাছে উপস্থাপন করছেন তার মাঝে অন্যতম হলো- Easter Island। গভীর সমুদ্রে মানুষের বসবাস রয়েছে কিন্তু যা কাছাকাছি মূল ভ‚খন্ড থেকে বহুদূরে, এমন দ্বীপের মাঝে এটি প্রথম। তবে বন ধ্বংসকরণ, সম্পদের যথেচ্ছ ব্যবহার, অদূরদশির্তা, পরিবেশ ও বাস্তসংস্থানের ভারসাম্যহীনতার জন্য এ সভ্যতার ধ্বংস নেমে আসে বলে বিজ্ঞানীরা মত প্রকাশ করেন। বিজ্ঞানীদের আরেকটি দলের মতে, ইউরোপীয় সংস্পর্শে এসে ‘গুটি বসন্ত’ (Pox) সংক্রমনে তাদের ধ্বংস হয়। Anne Van, Paul Rainbird সহ বিজ্ঞানীরা দেখিয়েছেন যে, Easter Island এখনো একটি ‘রহস্য’। Dr. Rainbird বলেন, ‘যখন আমরা এখানে এসে বিশালাকৃতির মূর্তিগুলো দেখলাম, তখন অবাক হয়ে গেলাম যে, কারা এবং কেন এইগুলো তৈরি করেছে?’। মূলত: এ ব্যাখ্যায় বিজ্ঞানীদের মাঝে মতভেদ রয়েছে। আলোচ্য প্রবন্ধে এ ‘রহস্য’ (Mystery) অধ্যয়নের Ecological Disaster সংক্রান্ত চিন্তাকে গুরুত্বের সাথে তুলে ধরে বর্তমান বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে এর প্রাসঙ্গিকতা উপস্থাপন করা হয়েছে।
বিশ্ব মানচিত্রে Easter Island
চিলি (Chile)’র পশ্চিম উপকুল থেকে প্রায় ২৩০০ মাইল ও Tahiti’র প্রায় ২৫০০ মাইল দূরে দক্ষিণ প্রশান্ত মহাসাগরে Easter Island এর আয়তন প্রায় ৬৪ বর্গমাইল বিশ্ব মানচিত্রে এই দ্বীপটির অবস্থান প্রায় ২৭০৭ দক্ষিণ অক্ষাংশ থেকে ২৭০১৭ এবং ১০৯০২২ পূর্ব দ্রাঘিমাংশ থেকে ১০৯০২৭ পূর্ব দ্রাঘিমাংশের মধ্যে।
আবিষ্কার ও নামকরণ
আমাদের কাছে এই দ্বীপটার নাম Easter Island হলেও স্থানীয়দের কাছে এটি পরিচিত Rapa Nui নামে। মূলত; ১৭২২ সালের ৫ই এপ্রিল, ডাচ্ অনুসন্ধানকারী Jacob Roggeveen এই দ্বীপ আষ্কিার করেন, সেদিনটা ছিল Easter Sunday; এ দিনের প্রতি সম্মান প্রদর্শন করে এই নাম রাখা হয়। তবে তিনি নাম রেখেছিলেন Paach-Eyland যার ইংরেজি প্রতিশব্দ হলো-Easter Island। আর সরকারীভাবে স্প্যানিশ নাম হলো Isla de Pascua।
Easter Island এর ইতিহাস
কারা এবং কবে এই দ্বীপে প্রথম বসতি স্থাপন করে সে নিয়ে ভিন্ন মতামত দেখা যায়। ধারণা করা হয় যে, ৩০০-৪০০ সালের দিকে আশেপাশের এলাকা হতে মানুষজন এখানে এসে বসতি স্থাপন করে। তাদের প্রথম রাজার নাম ছিল Hoto-Matua । তবে ১৯৫০ সালের দিকে বিখ্যাত অনুসন্ধানকারী (Explorer) Thor Hoyer Dahl মত দেন যে, তারা এসেছিল মূলত; দক্ষিণ আমেরিকা থেকে। University of Oslo এর অধ্যাপক Erika Hagelberg উক্ত মতামত খারিজ করে প্রমান করেন যে, এরা ছিল Polynesians। তার ভাষায় ‘These people had to have been descendants of Polynesions’। তিনি একজন বিখ্যাত জিন বিশেষজ্ঞ, DNA পরীক্ষার মাধ্যমে তিনি এ সিদ্ধান্তে আসেন। তার মতে, Polynesian রা ছিল পৃথিবীর বিখ্যাত সমুদ্র বিজয়ী দল, তারা প্রায় ৩৫০ টির মত দ্বীপ আবিষ্কার করে । এক দ্বীপ থেকে অন্য দ্বীপে বসবাস যাতায়াত ও ব্যবসা বাণিজ্য পরিচালনা করে। Carbon dating করে জানা যায় যে, ৭০০ সালের দিকেই Polynesians রা এ দ্বীপে বসবাস শুরু করে। তবে, পরবর্তী ১০০০ বছরে কেউ এখানে আসেনি বলে বিজ্ঞানীরা জানান।
ইউরোপীয় যোগাযোগ ও বর্তমান অবস্থা
১৭২২ থেকে ১৭৯৫ সাল পর্যন্ত ইউরোপীদের সাথে Papa Nui বা Easter Island এর যোগাযোগ হয়েছে মাত্র ৭ বার । প্রথম চারটি ছিল যথাক্রমে জড়মমবাববহ (১৭২২), Gonzalez (১৭৭০), Cook (১৭৭৪) ও La Perase (১৭৪৬); যারা ছিলেন সবাই অনুসন্ধানকারী। এছাড়া ১৭৯২, ১৭৯৩ ও ১৭৯৫ সালে ৩ বার ব্যবসায়িক নোঙর স্থাপন করা হয় (Pollard et at.2010) । এমন কি উনবিংশ শতকেও এ দ্বীপে যাতায়াত ছিল খুবই নগন্য ও বিছিন্ন (Richards. R., 2008)। তবে ধীরে ধীরে এ যোগযোগ বাড়তে থাকে । ১৯৭৮ সালে Alexander Salmon নামের একজন ইহুদী ব্যবসায়ী এই দ্বীপসহ বেশ কয়েকটি Polynesian দ্বীপ কিনে নিয়ে ১৯৮৮ সাল পর্যন্ত প্রত্নতাত্ত্বিক গবেষণার জন্য সুব্যবস্থা করে দেন। ১৮৮৮ সালে এই দ্বাপটি চিলির অন্তর্ভূক্ত হয়। ১৯৬৬ সালে Papa Nui আদিবাসীদের চিলির নাগরিকত্ব দেয়া হয়। ১৯৯৫ সালে UNICCO Easter Island কে World Heritage site হিসেবে ঘোষনা দেয়। ১৯৯৯ সালে Mangareva ১৯ দিনে এই দ্বীপে পৌছাতে সক্ষম হন এবং এখানকার রহস্য উদঘাটন করতে থাকেন।
Easter Island সভ্যতা
১. এ সভ্যতার অন্যতম নিদর্শন হলো বিশালাকৃতির মূর্তিগুলো, যার স্থানীয় নাম Moai। প্রায় ১০০০’র মত মূর্তিগুলোর মাঝে প্রত্নতত্ত্ববিদরা দেখান যে, এখনো ৩০০’র মত মূতি রয়েছে। অনেকের মতে, এ সংখ্যাটা হবে ৮৮৭ টির মাঝে ২৮৮ টি মূর্তি। মূর্তিগুলো প্রায় ১৩-৩২ ফুট উঁচু ও ১০-৮৭ টন ওজনের।
২. এটি ছিল বৃহৎ ও সমৃদ্ধ বর্ধণশীল জনসংখ্যার একটি সভ্যতা। এখানকার বসতবাড়িওলো ছিল ২০-৩০ জনের আবাসস্থল। সমাজগুলো ছিল ১১-১২ টি Clan এ বিভক্ত। ১৫৫০ সালের দিকে এখানে প্রায় ৭০০০-৯০০০ লোক বসবাস করতো। সেখানে শুরুর দিকে ছিল ১২,০০০ মত।
৩. এ সভ্যতার অর্থনীতি ছিল মূলত; মূর্তিভিত্তিক (Statue based economy) । শ্রম, শ্রমিক, শ্রমিকের খাদ্য, পারিশ্রমিক সবই ছিল মূর্তিকেন্দ্রিক। এছাড়া কৃষিকাজের প্রমাণও পাওয়া যায় এখানে।
৪. এখানে ছিল অসংখ্য পাম গাছ, যেগুলো Oak গাছের মত বিশাল, উচু হতো। এছাড়া এখানে ছিল Tuna, Turtles, Seals Porpoises। তবে ১৭২২ সালের মধ্যে ২৫ প্রজাতির মাছ ও পাখি বিলুপ্তি হতে থাকে।
সভ্যতা ধ্বংসের কারণ সমূহ
Tuna Easter Island সভ্যতা ধ্বংসের পেছনে বিজ্ঞানীরা প্রতিবেশগত বিপর্যয় এর মূল কথা গুরুত্বের সাথে উপস্থাপন করেছেন। মূলত J. Diamond তার Collapse (২০০৫) নামক বইতে এ সভ্যতা ধ্বংসের পেছনে মানব সৃষ্টি Ecological Disaster, ‘Ecocide’ কেই মূখ্য দায়ী হিসেবে উপস্থাপন করে-যা প্রভাবশালী একটি মত। এ বিষয়টি বুঝতে হলে আমাদের পরিবেশ ও প্রতিবেশ সম্পর্কে জানতে হবে। পরিবেশ বলতে সাধারণত বুঝানো হয়, একটি জটিল প্রাকৃতিক উপাদানের যৌগ, যার উপর আমরা নির্ভর করি ও অভিযোজন করে বেঁচে থাকি (হালদার, ২০০০)। আর প্রতিবেশ হলো মানুষ ও পরিবেশের মধ্যকার মিথস্ক্রিয়া, আন্তসম্পর্ক । প্রতিবেশবিদ্যা হলো জীবনের (জীবের) সকল নেটওয়াকের পরস্পর নির্ভরতা অধ্যয়ন (হোসেন, ২০০২)।
১. Papa Nui বাসীরা বিশালাকৃতির মূর্তিগুলো তৈরিতেই অধিক বিনিয়োগ ও শ্রম দিয়েছিলেন। এজন্য তাদের মাঝে প্রতিযোগিতা লক্ষ করা যায়। এ মূর্তি বা Moai ছিল তাদের কাছে ‘Living face of our ancestors’।
২. পূর্বপুরুষদের মনে রাখা, উন্নতি বিপদ থেকে এ মূর্তিগুলো তাদের রক্ষা করবে এমন অন্ধবিশ্বাস ও ধর্মী গোড়ামী তাদের পেয়ে বসেছিল। Sergio Pappo বলেন, ‘The statues are full of pride, the mouth firm, the nose elevated’।
৩. সময়ের সাথে সাথে Papa Nui অধিবাসীদের সংখ্যাও বাড়তে, যার ফলে প্রতিবেশগত বিপর্যয় নেমে আসে।
৪. Papa Nui বাসীরা তাদের সীমিত সম্পদ ও প্রাকৃতিক সম্পদ ব্যবহারে অদূরদশির্তার প্রমাণ দিয়েছিলেন, যার পরিমিত তাদের ভোগ করতে হয়েছে।
বর্তমান বিশ্বের জন্য ইস্টার আইল্যান্ড এর সতর্কতা
বন ধ্বংস করণ, প্রাকৃতিক সম্পদ ব্যবহারে অদূরদর্শিতার ফলে বর্তমান বিশ্বে জলবায়ু পরিবর্তন, পরিবেশ বিপর্যয়, বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধি পাচ্ছে। জনসংখ্যা বৃদ্ধির সাথে সাথে তাদের চাহিদা মেটানোর জন্য যথাযথ পরিমানে উৎপাদন বৃদ্ধি পাচ্ছে না। বর্তমান বিশ্বের নানা প্রাকৃতিক সম্পদ যেমন পাথর, খনিজ, মাছ, পাখি, গাছ এর অপরিকল্পিত ব্যবহারে এক সময় এগুলো নি:শেষ হয়ে যাবে এবং পৃথিবী ইস্টার আইল্যান্ড এর মত বিলীন হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। তাই বর্তমান বিশ্বের জন্য ইস্টার আইল্যান্ড অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক এবং শিক্ষনীয় বলে আমার মনে হয়।
………………………………………
খলিলুল্লাহ মুহাম্মাদ বায়েজীদ
সমাজবিজ্ঞান ও নৃবিজ্ঞান বিভাগ,
এশিয়ান ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশ