আমাদের পৃথিবী বৈচিত্র্যময়। একই দেশের ভিতরে নানান শ্রেণির, গোত্র, ও বর্ণের লোক পাশাপাশি বসবাস করে। প্রতিটি সমাজেরই নিজস্ব সংস্কৃতি ও নিজস্ব স্বকীয়তা বিদ্যমান। সবার চাল-চলন, আচার অনুষ্ঠান একইরকম নয়। সমাজভেদে ভিন্ন রকম সংস্কৃতির চর্চা হবে, এটাই স্বাভাবিক! ফলশ্রুতিতে, নিজের সংস্কৃতিসহ অপর সংস্কৃতিকে দেখার বা চর্চা করার পদ্ধতিও একইরকম হবে না। এই দৃষ্টিভঙ্গিতেই নৃবিজ্ঞানের সাথে অন্যান্য সামাজিক বিজ্ঞানের পার্থক্য ফুটে উঠে।অন্যান্য বিষয় থেকে নৃবিজ্ঞানকে স্বতন্ত্র করেছে কয়েকটি বিষয়। এগুলো হলোঃ
১। সামগ্রিকতাবাদঃ
নৃবিজ্ঞান হল একটি সামগ্রিক বিজ্ঞান, যা বুঝায় যে নৃবিজ্ঞান মানুষের সকল কর্মকান্ড সেটা অতীত, বর্তমান বা ভবিষ্যৎ ; আঞ্চলিক, জাতীয়, বা আন্তর্জাতিক বিষয়, ইউরোপীয় বা অ-ইউরোপীয়সহ, সকল দিকগুলোর সমাজ ও সংস্কৃতি অধ্যয়ন করে। নৃবিজ্ঞানীরা হোমো স্যাপিয়েন্স এবং আধুনিক মানুষের বিবর্তনীয় পূর্বপুরুষদেরকে দেখেন, সম্ভাব্য বিস্তৃত প্রেক্ষাপটে- জৈবিক ও সাংস্কৃতিক প্রাণী হিসেবে। অন্য কথায়, যতদিন মানুষ এবং তাদের পূর্ববর্তী মানবসদৃশ পূর্বসূরীরা একটি প্রজাতি হিসাবে বিদ্যমান ছিল ততদিন নৃবিজ্ঞান মানুষের সম্পর্কে সবকিছু অধ্যয়ন করে। মানুষের নির্দিষ্ট বিষয়ের বিশদ জিনিসের বর্ণনা না করে বরং বিস্তৃত ও সমন্বিত বিষয়গুলোর প্রতি আলোকপাত করে৷ উদাহরণস্বরূপ, একজন জীবাশ্মবীদ আধুনিক মানুষের জৈবিক পূর্বপুরুষদের সাংস্কৃতিক অভিযোজন বিবেচনা করেন। নৃবিজ্ঞানের দ্বারা আলোচিত বিস্তৃত সময়সীমা তাৎপর্যপূর্ণ কারণ নৃবিজ্ঞানীরা বিশ্বাস করেন যে সমসাময়িক মানব অভিযোজন সম্পর্কে যেকোন অন্তর্দৃষ্টি, হয় জৈবিক বা সাংস্কৃতিক, অতীত অভিযোজনের দিকে নজর রেখে করা উচিত।
২৷ ফিল্ডওয়ার্কঃ
নৃবিজ্ঞানের ক্ষেত্রে পুরো বিশ্বই একটি ফিল্ড। অন্যান্য বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে দেখা যায় যে তারা নির্দিষ্ট একটি ল্যাবের ভিতরে গবেষণা কাজ পরিচালনা করে, নৃবিজ্ঞান এখানে ব্যতিক্রম! নৃবিজ্ঞান গবেষণা বেশিরভাগ ই হয় সরাসরি মাঠের মধ্যে। নৃবিজ্ঞানে এথনোগ্রাফির মাধ্যমে প্রাথমিক তথ্য সংগ্রহ করা হয়। সাধারণত নৃবিজ্ঞানের চারটি শাখারই ফিল্ডওয়ার্ক করা যায়।
ক) সাংস্কৃতিক নৃবিজ্ঞানে ক্ষেত্রে ফিল্ডওয়ার্কঃ সাংস্কৃতিক নৃবিজ্ঞানীরা ফিল্ডে গিয়ে তাদের প্রাথমিক তথ্য সংগ্রহ করে। মানুষ এবং তাদের জীবন পদ্ধতি সম্পর্কে অন্তর্দৃষ্টি একটি সম্পূর্ণ নতুন মাত্রা গ্রহণ করে যখন কেউ তাদের সংস্কৃতিকে সরাসরি অনুভব করে। সাংস্কৃতিক নৃবিজ্ঞানীরা বলেন যে অন্য সংস্কৃতি, উপসংস্কৃতি বা মাইক্রোকালচারকে সত্যিকার অর্থে জানতে হলে সেই সাংস্কৃতিক পরিবেশে বিস্তৃত সময় ব্যয় করতে হবে। এথনোগ্রাফিক উপাত্তের সাহায্যে সেগুলোর তুলনামূলক বিশ্লেষণ করা হয়৷
খ) প্রত্নতত্ত্বের ক্ষেত্রে ফিল্ডওয়ার্কঃ প্রত্নতাত্ত্বিকরা প্রথমে ফিল্ডে গিয়ে আর্টিফ্যাক্ট এবং ইকোফ্যাক্টগুলো খনন এবং পুনরুদ্ধার করেন। এই ক্ষেত্রে ফিল্ডওয়ার্ক হচ্ছে প্রথম ধাপ। প্রতিটি প্রত্নতাত্ত্বিক সাইটগুলোর ম্যাপ করা হয় এবং খনন শুরু করার আগে রেকর্ড করা হয়। খনন এবং যত্ন সহকারে যাতে মাটি থেকে কোনো আইটেম সরানোর আগে প্রতিটি আর্টিফ্যাক্ট , ইকোফ্যাক্ট এবং বৈশিষ্ট্যের সঠিক অবস্থান রেকর্ড করা হয়।
গ) ভাষাতাত্ত্বিক নৃবিজ্ঞানে ফিল্ডওয়ার্কঃ ভাষাবিজ্ঞানের বেশিরভাগ দিকগুলির জন্য ফিল্ডে গিয়ে প্রাথমিক উপাত্ত সংগ্রহ করা হয়। বর্ণনামূলক ভাষাতত্ত্ব নির্ভর করে স্থানীয় ভাষাভাষীদের সাথে পারস্পরিক যোগাযোগের উপর। যদিও এটি একটি ল্যাবরেটরি পরিবেশে করা যায় তবে ভাষাগুলির গঠন এবং অন্যান্য দিকগুলি বর্ণনা করার প্রাথমিক কাজ বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই ফিল্ডে গিয়ে করা হয়। যে সমাজের উপর গবেষণা করা হয় সেসব সমাজের ব্যক্তিদের দ্বারা ভাষা কীভাবে ব্যবহার করা হয় তা পরবর্তীতে বোঝার জন্য এই ফিল্ডওয়ার্ক গুরুত্বপূর্ণ৷ তাছাড়া ঐ সমাজের লোকজন ভাষার মাধ্যমে কিভাবে নিজেরা যোগাযোগ স্থাপন করে সেটাও বুঝা যায়।
ঘ) জৈবিক নৃবিজ্ঞানে ফিল্ডওয়ার্কঃ জীবাশ্মবিদ, যারা মানব বিবর্তনকে বিশ্লেষন ও ব্যাখ্যা করে তাদের অবশ্যই ফসিলের প্রয়োজন পড়ে এবং এটাকে মূল্যায়ন বা বিশ্লেষণ করার জন্য অবশ্যই তাদের ফিল্ডওয়ার্কে যেতে হবে। ফিল্ড ওয়ার্ক থেকে প্রাপ্ত বিভিন্ন ফসিলের, বা মানব সদৃশ অন্যান্য প্রাণী যেমন গেরিলা, শিম্পাঞ্জি, বানর এদের সাথে আধুনিক মানুষের অথবা বিভিন্ন ফসিলের আকার আকৃতি, গাঠনিক রূপ এসবের সাহায্য মানুষের পূর্বপুরুষদের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিশ্লেষন করা যায় ও বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা দান করা যায়।
জৈবিক নৃবিজ্ঞানীরা যারা সমসাময়িক বিরল মানুষের বৈচিত্র অধ্যয়ন করেন তারা ফিল্ডেও তথ্য সংগ্রহ করেন এগুলোর মধয়ে রক্তের নমুনা, ডিএনএর নমুনা, গাঠনিক রূপ, যেহেতু তারা মানুষের জৈবিক বৈচিত্র্য ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করে।
তবে, অবশ্যই, এই তথ্যগুলির বেশিরভাগই কম্পিউটার এবং ল্যাব সুবিধাগুলি ব্যবহার করে সম্পন্ন করা হয়।
৩। তুলনামূলক অধ্যয়নঃ
নৃবিজ্ঞানীরা উপাত্তগুলো সাধারণীকরণ করার আগে যতটা সম্ভব ডেটা সংগ্রহ করে এবং তুলনা করে। নৃবিজ্ঞানীরা মানুষের অবস্থা সম্পর্কে ব্যাখ্যামূলক বা বিশ্লেষণাত্মক বিবৃতি তৈরি করতে শুধুমাত্র একটি গবেষণার তথ্যের উপর নির্ভর করে না।উদাহরণস্বরূপ, একজন সাংস্কৃতিক নৃবিজ্ঞানী মানুষের পরিবারের গঠন পরীক্ষা করার জন্য,মানুষ সম্পর্ক এরিয়া ফাইলের ডেটা দেখবেন যা শত শত বিভিন্ন সংস্কৃতির ক্ষেত্রের অধ্যয়ন থেকে সংগ্রহ করা হয়েছে। পারিবারিক কাঠামোর বৈশিষ্ট্যগুলি তুলনা করা হয়, সাদৃশ্য এবং বৈসাদৃশ্যগুলো বর্ণনা করা হয়, সংখ্যাগতভাবে সারণী করা হয় এবং পরিসংখ্যানগতভাবে বিশ্লেষণ করা হয়। তুলনামূলক পদ্ধতিটি প্রত্মতত্ত্ব, ভাষাগত এবং জৈবিক নৃবিজ্ঞানেও ব্যবহৃত হয়। জীবাশ্মবিদরাও তুলনামূলক পদ্ধতি ব্যবহার করেন যখন একটি নতুন ফসিল আবিষ্কৃত হয়৷ তবে, মানবিক নৃবিজ্ঞানে প্রতিটি ব্যক্তি ও সংস্কৃতির স্বতন্ত্রতা বজায় রাখা হয় এবং সেখানে কোন তুলনামূলক পদ্ধতি ব্যবহার করা হয় না৷
৪। সাংস্কৃতিক আপেক্ষিকতাঃ
এটার মূল আলোচনা হচ্ছে নৃবিজ্ঞানীরা যে সমাজ বা সংস্কৃতি নিয়ে গবেষণা করে সে সমাজ বা সংস্কৃতিকে তারই প্রেক্ষাপটে বিবেচনা করে। একটি সমাজ বা সংস্কৃতির লোকজন কি খায়, কি পড়ে, কিভাবে তাদের জীবন যাপন শুরু করে এসব কিছু তাদের সংস্কৃতির আলোকেই বিবেচনা করতে হবে। সেই সংস্কৃতি অনুন্নত, বর্বর, পিছিয়ে পড়া, অদ্ভুত, অনৈতিক, এসব শব্দ দিয়ে ব্যাখ্যা করা যাবে না। নিজের সংস্কৃতির বিভিন্ন অংশ যেমন খাবার, পোষাক, ধর্মীয় রীতিনীতি, আচার-অনুষ্ঠান এসব অন্য সংস্কৃতির চেয়ে উন্নত বা এগিয়ে এইরকম ভাবনা চিন্তা করা যাবে না। স্বজাত্যবোধ পরিহার করে। সাংস্কৃতিক আপেক্ষিকতা বলতে এটা বুঝায় না যে ভিন্ন সমাজের সংস্কৃতির কোন অংশ যেমন খাওয়া দাওয়া বা পোষাক পরিচ্ছেদ নিজের সংস্কৃতির মতো লালন করা নয় বরং ভিন্ন সংস্কৃতির প্রতি ইতিবাচক ধারণা পোষন করা ই বুঝায়৷ নৃবিজ্ঞানের এই দৃষ্টিভঙ্গিটি তাঁকে অনন্য উচ্চতায় নিয়ে গিয়েছে।
অন্যান্য বিষয়গুলোর সাথেও নৃবিজ্ঞান নানানভাবে জড়িত! বিশেষ করে সামাজিক বিজ্ঞানের বিষয়গুলো নৃবিজ্ঞান সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িত।নৃবিজ্ঞান ও সমাজবিজ্ঞান যেনো পরস্পর সহোদর! সমাজবিজ্ঞানের বিভিন্ন ধারণা যেমন সামাজিক স্তর বিন্যাস, সমাজ, সম্প্রদায়, সামাজিক সংগঠন এগুলো পরবর্তীতে নৃবিজ্ঞানে ভিন্ন ভাবে আলোচিত হয়। বিভিন্ন সমাজবিজ্ঞানী, পর্যটক, ভ্রমণকারী নৃবিজ্ঞানের তত্ত্ব প্রতিষ্ঠায় অবদান রাখেন। প্রাকৃতিক বিজ্ঞানের কিছু বিষয়ও নৃবিজ্ঞানের সাথে সম্পর্কিত। যেমন যখন কোনো ফসিল বা আর্টিফ্যাক্ট খুঁজে পাওয়া হয় তখন এর পরীক্ষা, নিরীক্ষা করার জন্য জীববিজ্ঞানের মুখোমুখি হতে হয়।কোনো এলাকার রাজনৈতিক ব্যবস্থার ধরন জানতে ও বুঝতে হলে ঐ নৃবিজ্ঞানকে রাষ্ট্রবিজ্ঞান ও ইতিহাসের সম্মুখীন হতে হয়। আবার, নৃবিজ্ঞানীরা যখন মাঠকর্ম করেন তখন তার নিকট ম্যাপিং অপরিহার্য বিষয় হয়ে দাঁড়ায়। এই ম্যাপিংয়ের সাহায্যে সংশ্লিষ্ট এলাকার কোন জায়গায় কোন কোন প্রতিষ্ঠান রয়েছে, বসতবাড়ির ধরণ ও আকৃতি এসব নিয়ে সুস্পষ্ট ধারণা পাওয়া যায়। ফলশ্রুতিতে, একজন এথনোগ্রাফার সহজেই তার ইনফর্মেন্ট ও উপাত্ত সংগ্রহ করতে পারেন। এটার জন্যই নৃবিজ্ঞানের সাথে ভূগোল ও ভূমিরূপবিদ্যার সম্পর্ক পাওয়া যায়৷ এথনোগ্রাফার উপাত্ত সংগ্রহ করার পর সেগুলো সাজানো ও উপস্থাপন করার জন্য পরিসংখ্যানের বিভিন্ন মেথড ব্যবহার করে। এছাড়াও অন্যান্য বিজ্ঞানের সাথে নৃবিজ্ঞানের সম্পর্ক রয়েছে বিভিন্নভাবে। আমেরিকান নৃবিজ্ঞানী ক্লাইড ক্লুকহোনের মতে, নৃবিজ্ঞান হচ্ছে মানবের সাদৃশ্য ও বৈসাদৃশ্যের বিজ্ঞান।
একটি পূর্নাঙ্গ জ্ঞানকান্ড হিসেবে নৃবিজ্ঞানের বৈশিষ্ট্য ও নিজস্ব স্বতন্ত্রতা রয়েছে৷ নৃবিজ্ঞান শুধু মানুষের সংস্কৃতিকে তুলে ধরে না, বরং মানুষের ও অন্যান্য প্রাইমেটের পরিপূর্ণ বিশ্লেষন করে৷ নৃবিজ্ঞান চর্চা মানুষকে তার নিজস্ব সংস্কৃতিকে যেমন জানতে ও বুঝতে সহায়তা করে অপরদিকে অন্য সংস্কৃতির প্রতি শ্রদ্ধাবোধও থাকে।
রেফারেন্স সমূহঃ
- Cultural Anthropology: Appreciating Cultural Diversity By Conrad Phillip Kottak
- Mirror for Humanity: A concise Introduction to Cultural Anthropology By Conrad Phillip Kottak
- নৃবিজ্ঞানের প্রথম পাঠঃ সমাজ ও সংস্কৃতি, লেখকঃ রেহনুমা আহমেদ, মানস চৌধুরী।
লিখেছেনঃ নুরুল আমিন, শিক্ষার্থী, নৃবিজ্ঞান বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।
[লেখার সকল দায়বদ্ধতা লেখক সংরক্ষণ করবেন]